মদ ও মাদক শত শত বছর ধরে যেভাবে যুদ্ধে উদ্দীপনা জুগিয়ে আসছে সেনাদের

 


ODD বাংলা ডেস্ক: একুশ শতকে পৃথিবীবাসী এক ধবংসলীলা দেখছে কৃষ্ণসাগর পাড়ে। ইউক্রেন ও রাশিয়া, যুদ্ধরত এ দুই প্রতিবেশী। রুশ যুদ্ধযন্ত্র আকারে ও সামর্থ্যে বহুগুণ শক্তিশালী। তারপরও আগ্রাসন প্রতিরোধে ভালো সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেন। পশ্চিমা সমর্থন পেয়ে টিকেও আছে কিয়েভ সরকার। ইউক্রেনীয়রা বলছে, রুশ সেনাদের মদ্যপানের আসক্তিই যুদ্ধের ময়দানে তাদের দুর্বল পারদর্শীতার কারণ। একটি দেশের সেনাবাহিনী সেদেশের সমাজ, সংস্কৃতির প্রতিনিধি, একইসঙ্গে সে সমাজের মদ্যপানের মাত্রাও সেনাদের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আর রাশিয়াতে সবার প্রিয় পানীয় 'ভদকা'। রুশ পুরুষদের ভদকার প্রতি অতি-আসক্তিই তাদের তুলনামূলক কম প্রত্যাশিত আয়ুর কারণ (গড়ে যা প্রায় ৬৪ বছর)।  


কিন্তু, এ যুক্তি তলিয়ে দেখবার দাবি রাখে। কারণ, সেনাদের মদ্যপানের ঘটনা বিরল তো নয়ই, বরং আরো শক্তিশালী মাদক তারা ব্যবহার করে আসছে। যেমন প্রাচীন কালে গ্রিক হপলাইট ও রোমান লিজিওনারিরা আকন্ঠ ওয়াইন বা সুরা পান করে যুদ্ধে যেত। যুদ্ধ এক প্রাণান্তকর সংগ্রাম। যুগে যুগে যুদ্ধের ময়দানে কখনো সেনাদের সেরা বন্ধু কখনোবা তার চরমতম শত্রু রূপেই আবির্ভূত হয়েছে অ্যালকোহল।     


বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পোলিশ অধ্যাপক লুকাস কামিনস্কি তার সমাদৃত বই 'শুটিং আপ: এ হিস্টোরি অব ড্রাগস ইন ওয়ারফেয়ার' - এ লিখেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখভাবে থাকা সেনারা এমন প্রচণ্ড (শারীরিক ও মানসিক) চাপের মধ্যে থাকে, বেসামরিক জনগণ যা কল্পনাও করতে পারে না। সেনাদের প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয়ের সাথে যুঝতে হয়, চারপাশে মৃত্যু ও ধবংসলীলার মধ্যেই করতে হয় লড়াই। অপরপক্ষকে হত্যার দায়িত্বও তাদের। সব মিলিয়ে বিষম এক চাপ বইতে হয় তাদের।


মানসিক চাপ সেনাদের হতোদ্যম করতে পারে, ভাঙ্গতে পারে মনোবল। আর কোনো সেনাবাহিনী যত আধুনিকই হোক না কেন, মনোবলের ক্ষয় মানেই নিশ্চিত পরাজয়। তাই প্রাচীনকাল থেকেই দেখা যায়, যথেষ্ট পরিমাণ অ্যালকোহল পান করে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এসব চাপ মোকাবিলা করতে পেরেছে সেনারা। এতে তাদের আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। দমিয়ে রাখা যায় হতাশার প্রবৃত্তিকে। স্নায়ুচাপ কিছু সময়ের জন্য কমাও লড়াইয়ে বড় পার্থক্য গড়তে পারে, যা অমূল্যও বলা যায়।


১৭ শতকে নেদারল্যান্ডসে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনারা তাদের প্রতিপক্ষের সাহসীকতাকে সমীহ করে বলতো 'ডাচ কারেজ' – আর এই বীরত্বের শক্তি ডাচরা পেত কয়েক পাত্র জিন পান করে।  ১৮৭৫ সনে ব্রিটেনের সশস্ত্র বাহিনীগুলো ৫৪ লাখ গ্যালন রাম নিঃশেষ করেছে। 'ব্রিটানিয়া রুলড দ্য ওয়েভস'– অর্থাৎ সমুদ্রে ব্রিটিশ আধিপত্যকে শক্তিও দিয়েছে এই রাম' নামক পানীয়। দৈনিক রেশনে যা অর্ধ পাইন্ট করে পেত ব্রিটিশ নাবিকরা।


বাড়াবাড়ি কোনো কিছুতেই ভালো নয়, মদে তো নয়ই। অতিরিক্ত অ্যালকোহল পানকারী মাতাল সৈন্যরা অসতর্ক হতে পারে, শৃঙ্খলাভঙ্গও করে। টিউটনিক প্রতিপক্ষের মদপানের দুর্বলতাকে এভাবেই কাজে লাগায় রোমানরা। এজন্য গোপনে তারা জঙ্গলে বিপুল পরিমাণ বিয়ার রেখে আসতো। আকন্ঠ পান করে শত্রু যখন বেহেড মাতাল, ঠিক তখনই সংঘবদ্ধ হামলা করে তাদের কচুকাটা করা হতো।  ১৯০৪-০৫ সনের প্রথম রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার হারের অন্যতম কারণও হয়তো ছিল ভদকার অতি-আসক্তি। এশিয়ায় রাশিয়ার প্রধান নৌঘাঁটি ছিল পোর্ট আর্থার।


জাপানিরা এই বন্দর অবরোধ করে। গোলাবারুদের জরুরি রসদের দরকার দেখা দেয় তখন। কিন্তু, সেই রসদের বদলে যখন ভদকার ১০ হাজার ক্রেট আসে, তখন পোর্ট আর্থার দুর্গের কমান্ডার আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন। এই যুদ্ধে স্থলভাগের একটি বড় সংঘাত ছিল 'ব্যাটেল অব মুকডেন' বা মুকডেনের লড়াই। তৎকালীন এক রুশ সাংবাদিক লিখেছেন, মুকডেনের লড়াইয়ে রুশ সেনারা এতটাই বেহেড মাতাল ছিল যে, জাপানিরা তাদের হাজার হাজার জনকে 'স্রেফ অসহায় শুকরের' মতো বেয়নেট বিদ্ধ করতে পেরেছিল।


একইভাবে মাদকও হাজারো বছর ধরে যুদ্ধে ব্যবহার হয়ে আসছে। যেমন গ্রিক যোদ্ধারা যুদ্ধপ্রস্তুতি নিতে আফিম সেবন করতো। দ্বাদশ শতকে আরব দুনিয়ার উগ্র 'অ্যাসাসিন'/ 'হাশাসিন'- নামক গুপ্তঘাতক সংঘ হাশিশ বা চরসের নেশায় মত্ত থাকতো। সাইবেরিয়ার কিছু উপজাতি এবং বিখ্যাত ভাইকিংদের মধ্যে বেজার্ক বা উন্মত্ত যোদ্ধারা এক ধরনের মাশরুম খেতো। অ্যামানিটা মাসকারিয়া ধরনের এই মাশরুমে থাকতো সাইকো-অ্যাকটিভ অ্যালকালয়েড। ফলে যোদ্ধারা সম্পূর্ণ ভীতিহীনভাবে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করতো। আবার কোকোয়া পাতা চিবিয়ে সহিংসতার সাহস, উদ্দীপনা পেতো মেসো-আমেরিকান যোদ্ধারা।       


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি উভয়পক্ষেই বিপুল শিল্পোৎপাদন হয়েছে অ্যাম্ফেটামিন নামক মাদকের। এই মাদকের ট্যাবলেট সেবনে অবশ্য জার্মান সেনাবাহিনী বা ওয়ারমাখটের সমান কেউই ছিল না। চিকিৎসা ইতিহাসবিদ নিকোলাস রাসমুসসেন- এর পর্যবেক্ষণ মতে: 'জার্মান ব্লিৎজক্রিগের চালিকাশক্তি যতোটা ছিল যন্ত্র, ঠিক ততোটাই ছিল অ্যাম্ফেটামিন'।


পার্ভিটিন নামে জার্মানিতে উৎপাদিত হতো মেথাম্ফেটামিন পিল। বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে জার্মানির দ্রুতগামী প্যানজার ডিভিশনগুলোর অক্লান্ত যুদ্ধযাত্রা সম্ভব হয়েছিল, জার্মান ট্যাংকারদের পার্ভিটিন পিল খাওয়ার ফলেই। পার্ভিটিনের এমনই প্রভাব, যে চোখের পাতা এক না করে– একের পর এক বাঁধা অতিক্রম করেছে প্যানজার বাহিনী।  


লুকাস কামিনস্কি বলেন, এই মাদক আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, ঝুঁকি নিতে প্ররোচিত করে, মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে; কমায় ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও ব্যথার অনুভূতি। এবং সর্বোপরি এর প্রভাব যতক্ষণ কাজ করে, ততোক্ষণ ঘুমও আসে না। আধুনিক যুদ্ধ কৌশলের পাশাপাশি এই মাদকের শক্তিতে ১৯৪০ সালের এপ্রিল ও জুলাইয়ে সামনের সমস্ত বাধা তছনছ করে বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে চলেছিল নাৎসিরা। এসময় তাদের সেনাদের সাড়ে ৩ কোটির বেশি পার্ভিটিন ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছিল।  


নাৎসি জার্মানির এই কৌশলকেই খুব সম্ভবত গ্রহণ করেছে রাশিয়া। লন্ডন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান – রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি)-র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, রাশিয়াও ইউক্রেন যুদ্ধে অ্যাম্ফেটামিন ব্যবহার করছে। রাশিয়ার সমর্থনে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ইউক্রেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে লুহানস্ক ও দনেয়স্ক। রুসির দাবি, এই দুই অঞ্চল থেকে রাশিয়ার পক্ষে যারা যুদ্ধ করছে, তাদের জীবনের মূল্য নেই ক্রেমলিনের কাছে। এদেরসহ নতুন করে অপ্রশিক্ষিত যেসব নাগরিকদের ভর্তি করা হচ্ছে, তাদের অ্যাম্ফেটামিনসহ নানান রকম মাদক তরল আকারে দিয়ে যুদ্ধে নামানো হচ্ছে। কার্যত, তাদের পাঠানো হচ্ছে আত্মঘাতী সব মিশনে।


এদের কাজই হলো মাদকে বুঁদ হয়ে ইউক্রেনীয় সেনা অবস্থানের দিকে অগ্রসর হওয়া, যাতে শত্রুরা তাদের ওপর গুলি চালায়। এভাবে ইউক্রেনীয় অবস্থান শনাক্ত হওয়া মাত্রই- সেগুলো লক্ষ্যবস্তু হয় রাশিয়ান কামানের। শুরু হয় ভারী গোলাবর্ষণ। আত্মঘাতী এই মিশন থেকে কেউ যদি পিছু হটতে চায়, তাহলে অন্য রুশ সেনাদের হাতেই ভবলীলা সাঙ্গ হয় তার। তাই কেন যে তাদের মাদকাসক্ত করে যুদ্ধে পাঠাতে হচ্ছে, সেটা ভেবে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

 

অন্যদিকে, মাতৃভূমি রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাওয়া ইউক্রেনীয়দের প্রেরণার জন্য মাদকের সাহায্য নিতে হয় না। তবে মাদক ও মদ যে তাদের অনেকের নিত্যদুর্ভোগ কিছুটা লাঘবে সাহায্য করছে, সে বাস্তবতাও মানতেই হয়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.