৭১ হাজার প্রাণী নিয়ে গবেষণা, সংখ্যা কমছে ৪৮ শতাংশের



 ODD বাংলা ডেস্ক: দুই শতাব্দী আগেও কোনো প্রাণীর বিলুপ্তি ছিল বিরল ঘটনা। তবে দ্বীপগুলোতে এমনটা দেখা যেত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ও উপনিবেশবাদীরা সেখানের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও অন্যান্য প্রাণী শিকার করত বা তাদের সঙ্গে আসা ইঁদুর বা বিড়ালের খাবারে পরিণত হত প্রাণীগুলো। 


শিল্প বিপ্লবে এ দৃশ্যপট বদলে যায়। দেশে দেশে বিলুপ্তির ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্রাণী কমে যাওয়ার প্রবণতাকে মোটামুটিভাবে মানব জনসংখ্যার সূচকীয় বৃদ্ধির সমান্তরাল বলা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। 


আধুনিক যুগে বন উজাড় করে সেগুলো সমতল ভূমি বানানো হয়েছে, বড় বড় দালান তোলা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ বন্য জমিকে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। 


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। ১৯৫০ সালে ২৫০ কোটি থেকে ২০২২ সালে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি। চলতি শতকে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। অন্যদিকে বন্যপ্রাণী দিন দিন কমে আসছে। 


কুইন্স ইউনিভার্সিটির বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এবং ম্যাক্রোইকোলজির সিনিয়র লেকচারার ড্যানিয়েল পিনচেইরা-ডোনোসো বলেন, 'বর্তমান সংকটের পিছনে প্রধান কারণ হল বাসস্থান ধ্বংস করা'।


ডোনোসো মে মাসে বায়োলজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণার সহলেখক। পিনচেরা-ডোনোসো এবং তার সহকর্মীরা ৭১ হাজার প্রজাতির প্রাণীর অবস্থান মূল্যায়ন করেছেন। কোন কোন প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে, কোন প্রাণীর সংখ্যা কমেছে এবং কোন কোন প্রাণীর সংখ্যা স্থিতিবস্থায় আছে, তার অনুসন্ধান করেছেন। পরীক্ষায় তারা ৪৮ শতাংশ প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা কমে আসছে বলে দেখতে পেয়েছেন। এই প্রবণতাকে গবেষকরা 'পৃথিবীতে মানুষের প্রভাবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিণতিগুলো একটি' বলে অভিহিত করেছেন। 


এই গবেষণায় বিবেচনা করা হয়েছে, প্রাণীগুলো কেমন আছে, তাদের সংখ্যায় কেমন পরিবর্তন আসছে। স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর ও মাছের পাশাপাশি কীটপতঙ্গ প্রজাতিও মূল্যায়ন করেছেন তারা। বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের বিশেষ প্রাণীর প্রতিও নজর দিয়েছেন গবেষকরা। 


গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, পৃথিবীর প্রায় ২৮ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। 


পিনচেরা-ডোনোসো বলেন, সংখ্যা হ্রাস ও বৃদ্ধির মধ্যে বিশাল বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়েছে যা 'আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ'। 


নতুন সমীক্ষা অনুসারে, মূল্যায়ন করা প্রজাতির মধ্যে ৪৮ শতাংশের সংখ্যা দিন দিন কমছে। মাত্র তিন শতাংশ প্রাণীর সংখ্যা বাড়ছে। আর ৪৯ শতাংশ প্রাণীর সংখ্যা স্থিতিশীল। প্রাণীর সংখ্যা বেশি কমছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে।  


সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যেসব প্রাণী নিরাপদ বলে বিবেচিত হতো এবং এখনো বিপন্ন তালিকায় নেই, তাদের এক তৃতীয়াংশ এমন সংখ্যায় মারা যাচ্ছে যা তাদের দীর্ঘমেয়াদে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। 


কানাডার ভ্যানকুভার আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী ও জৈবিক নৃতত্ত্ববিদ কলিন চ্যাপম্যান বলেন, 'একবার একটি প্রজাতি বিপন্ন হয়ে গেলে একে বাঁচানো কঠিন। সুতরাং আমাদের এমন প্রজাতি সম্পর্কে অনেক বেশি চিন্তিত হওয়া উচিত যেগুলো আইইউসিএন-এর তালিকাভুক্ত নয় তবে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।'


গবেষণায় দেখা গেছে, বিজ্ঞানীরা অনেক প্রজাতির সংরক্ষণের অবস্থা নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন। বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলের প্রাণীর তথ্য কম পাওয়া গেছে। 


ক্রমাগত হুমকি 


বিজ্ঞানীরা একমত যে, পৃথিবী ষষ্ঠবারের মতো ব্যাপক বিলুপ্তির পথে আছে। সর্বশেষ ৬.৬ কোটি বছর আগে ডাইনোসরের বিলুপ্তি হয়। এ ছাড়া ২৫ কোটি বছর আগে প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অতীত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো নির্দিষ্ট একটি কারণে বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে না। বরং অনেকগুলো কারণ মিলে বিলুপ্তির হুমকি তৈরি করে। 


তাত্ত্বিক বাস্তুবিদ স্টুয়ার্ট পিম জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির প্রধান চালক হিসেবে দ্রুত পরিবর্তনশীল জলবায়ু এবং বন উজাড়কে উল্লেখ করেছেন। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ প্রজাতির প্রাণীরই আবাস্থল বন। জাতিসংঘের অনুমান, গত তিন শতকের পৃথিবীর ১.৪ কোটি বর্গকিলোমিটার বন উজাড় হয়েছে। 


আমাজন নেটওয়ার্ক অভ জিওরিফারেন্সড সোসিও-এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশনের তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ব্রাজিলে ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গকিলোমিটার বন উজাড় হয়েছে। যা স্পেনের আয়তনের চেয়ে বেশি। গবাদি পশু, সয়া, ভুট্টা, আখ এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য উৎপাদন ও খনির কাজে  এসব বন উজাড় করা হয়। 


সেই সঙ্গে বাসস্থানের ক্ষতি এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে অনেক প্রাণী স্থানান্তরিত হচ্ছে। তবে স্থানান্তরে অক্ষমরা সংকুচিত আবাস্থলে আটকা পড়ছে। এ দুই কারণের পাশাপাশি বন্য প্রাণীর মাংস কেনাবেচার কারণেও অনেক প্রাণীর সংখ্যা কমছে। 


অনেক তথ্যই এখনও অজানা


গবেষকরা বলেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের তথ্য কম পাওয়া আছে। তাই আমরা সত্যিই জানি না সেখানে কী ঘটছে। 


উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাপী ৫৪ শতাংশ কীটপতঙ্গ হ্রাস পাচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকগুলো আমাদের ৭৫ খাদ্যের শতাংশ পরাগায়নে জড়িত। অথচ কীটের প্রকৃত সংখ্যা এখনো অজানা। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত ১০ লাখ কীট শনাক্ত করেছেন। তবে সম্ভবত ৪৫ থেকে ৭০ লাখ পর্যন্ত কীটের তথ্য বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা। গবেষণায় দেখা গেছে, সব মহাদেশেই বিপুল হারে কীট বিলুপ্ত হচ্ছে। আর সবচেয়ে কম জানা গেছে এখন পর্যন্ত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় কীটের তথ্য। যে অঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ। 


সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উভচর প্রাণীর বিলুপ্তির হার সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীর চেয়ে বেশি। তারমধ্যে লাতিন আমেরিকার বনাঞ্চলের পাহাড়ে থাকা রঙিন হারলেকুইন ব্যাঙের প্রজাতির আর দেখতে না পাওয়া সবচেয়ে উদ্বেগজনক বলছেন গবেষকরা। 


সংকট মোকাবেলা


যদিও বিলুপ্তি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার অংশ, তবে গবেষকে ডোনোসো বলেন, জলবায়ু খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং প্রাণীদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের আগেই পরিবর্তন হচ্ছে পরিবেশ। আর মানিয়ে নিতে না পারা মানেই বিলুপ্তি। পূর্ববর্তী বিলুপ্তির হার থেকে বর্তমানে বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষতি এক থেকে দশ হাজার গুণ বেশি হচ্ছে। 


গবেষক চ্যাপম্যান এবং পিম উভয়ই বলেন, প্রজাতিগুলো মারাত্মক সমস্যায় পড়ার আগে করণীয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় নতুন গবেষণায়। ২০২২ সালে জাতিসংঘের জীববৈচিত্র সম্মেলনে দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ জল ও ভূমি রক্ষায় সম্মত হয়েছিল। এ লক্ষ্য অর্জন কঠিন হলেও পতনের মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রজাতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, তথ্য কম জানা অঞ্চলগুলোতে মনোযোগ দিলে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। 


গবেষক ডোনোসো বলেন, জীববৈচিত্র হ্রাসের প্রবণতা কমিয়ে আনা বৈশ্বিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সরকার, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনী, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ও আদিবাসীরা একযোগে কাজ করলে প্রাণী শিকার, বণ্যপ্রাণী কেনা-বেচা এবং বন সুরক্ষা সম্ভব হবে। 


ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন হতেও মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। ডোনোসো বলেন, জ্বালানি ব্যবহার কমানো এবং রাসায়নিক সার কম ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকেই পরিবর্তন আনায় ভূমিকা রাখতে পারি। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.