যেভাবে শিল্পের বাজারকে বোকা বানিয়ে লাখ লাখ ডলার আয় করেছেন এই দম্পতি!
ODD বাংলা ডেস্ক: কয়েক দশক ধরে নকল চিত্রকর্ম আঁকা, মিথ্যা প্রমাণ দেওয়া এবং সযত্নে সত্য ধামাচাপা দিয়ে রাখার পর মাত্র এক মুহূর্তের অসতর্কতায় বেলট্রাকি জুটির প্রতারণা ধরা পড়ে যায়!
ওয়েফগাং বেলট্রাকি ও হেলেন বেলট্রাকি- এই জার্মান দম্পতি তাদের নকল চিত্রকর্মের জন্য হোয়াইট পেইন্ট তৈরিতে যে জিংক ব্যবহার করতেন, একদিন তা ফুরিয়ে যাওয়ার পর ওয়েফগাং একজন ডাচ প্রস্তুতকারকের কাছ থেকে জিংক পিগমেন্ট কিনেছিলেন। কিন্তু সেই বিক্রেতা তাকে জানাননি যে এতে টাইটানিয়াম রয়েছে।
পরের বছর ওয়েফগাং তার একটি নকল শিল্পকর্ম 'রেড পিকচার উইথ হর্সেস'কে বিখ্যাত এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী হাইনরিখ কাম্পেনডোংকের শিল্পকর্ম বলে চালিয়ে দেন এবং নিলামে রেকর্ড ২.৮ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করেন। আর এখানেই একটি অসঙ্গতি ধরা পড়ে। চিত্রকর্মটি বিশ্লেষণ করে এতে টাইটানিয়ামের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, কিন্তু এই পদার্থটি হোয়াইট পিগমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয় ১৯২০-এর দশক থেকে। অথচ হাইনরিখের ওই চিত্রকর্মটি ১৯১৪ সালের বলে বিবেচিত।
এই চিত্রকর্মটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরপরই একের পর এক ঘটনার সত্য উন্মোচন হতে থাকে যে কিভাবে বেলট্রাকি দম্পতি সারা বিশ্বের বাঘা বাঘা ধনকুবের এবং গ্যালারিগুলোকে বোকা বানিয়ে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে চলেছেন। ওয়েফগাং-এর পেইন্টিংগুলো নিলাম হাউজ থেকে শুরু করে অভিনেতা স্টিভ মার্টিনের মতো শিল্প সংগ্রাহকদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে স্থান পেয়েছিল। এমনকি বেলট্রাকি দম্পতি একজন বিশেষজ্ঞ শিল্প মূল্যায়নকারীকে ধোঁকা দিয়েছেন- কিংবা প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে তার মুখ বন্ধ রেখেছেন।
২০১৪ সালে জার্মানির মোরিটজবুর্গ আর্ট মিউজিয়ামে ওয়েফগাং এর আঁকা নকল শিল্পকর্ম 'টু রেড হর্সেস ইন ল্যান্ডস্কেপ' দেখছেন এক নারী। ছবি: পিটার এনডিগ/পিকচার এলায়েন্স/গেটি ইমেজেসে
প্রায় ৩০ বছর ধরে এই প্রতারণামূলক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পর ২০১১ সালে ওয়েফগাং ও হেলেন বেলট্রাকিকে ৬ বছরের কারাদণ্ড এবং এর মধ্যে ৪ বছর কারাগারে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও পরে তাদেরকে সাজার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কিছুটা আগেভাগেই ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও, ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩৫ মিলিয়ন ইউরো পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয় তাদেরকে।
বিদ্যমান পেইন্টিংগুলো জাল করার পরিবর্তে ওয়েফগাং নিজেই শত শত নতুন চিত্রকর্ম এঁকেছেন যেগুলোতে ম্যাক্স এর্নস্ট, ফের্নো লিজে, কেইস ফন দোগেন ও অঁদ্রে ডেরার মতো প্রয়াত ইউরোপিয়ান শিল্পীদের কাজের ধরন সুনিপুণভাবে অনুকরণ করেছেন তিনি। তার স্ত্রী হেলেন এগুলোকে পূর্বে নথিভুক্ত করা হয়নি-এমন শিল্পকর্ম হিসেবে বিক্রি করেছেন, কখনো কখনো চোখ ধাঁধানো দামে। এই জুটি দাবি করেছেন যে, হেলেনের দাদি হিটলারের সময় জার্মানি ত্যাগ করা এক ইহুদি গ্যালারিস্টের কাছ থেকে এই শিল্পকর্মগুলো সংগ্রহ করেছিলেন এবং তার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো পেয়েছেন তারা।
কিন্তু তাদের এই দাবি যে আগাগোড়া মিথ্যা এবং তাদের প্রতারণার বিস্তারিত তথ্য একাধিক পত্রপত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছে। সেইসঙ্গে একটি প্রামাণ্যচিত্র এবং ২০১১ সালে তাদের মামলায় শুনানিতেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে সাইকোঅ্যানালিস্ট জ্যানেট ফিশার গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যে কেন বেলট্রাকি জুটি এই বিশাল প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন। বেলট্রাকি জুটি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুইজারল্যান্ডে তাদের স্টুডিওতে বসে কফি কিংবা ওয়াইন পান করতে করতে তাদের সঙ্গে একাধিকবার আলাপচারিতায় বসেছিলেন জ্যানেট। আর এই আলাপচারিতার মাধ্যমেই তিনি তাদের এই জালিয়াতির উদ্দেশ্য, শৈল্পিক প্রক্রিয়া ও পারিবারিক ইতিহাস বের করার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু ফলাফলে এমন একজন মানুষের জটিল চিত্র উঠে আসে যার কাছে এই প্রতারণা শিল্পেরই একটি সৃজনশীল রূপ! ওয়েফগাংকে নিয়েই মূলত বইটি লেখা হয়েছে, যার কাছে এই প্রতারণা একটা খেলার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি ও তার স্ত্রী হেলেন এই জালিয়াতির মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিলেও, টাকা এখানে তাদের কাছে মূল আকর্ষণ ছিল না বলে বলছেন ফিশার। যদিও এই জুটি সেই টাকা দিয়ে বেশ সচ্ছল জীবনযাপনই করেছেন, বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেছেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সে একটা বাড়িও কিনেছেন; কিন্তু বিপুল পরিমাণ টাকা তাদের হাতে থাকা সত্ত্বেও তারা অনেক ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি করেননি।
"এই জালিয়াতি ঘটনাক্রমে হয়েছে বলা যায়। আমরা এই চিত্রকর্মগুলো বিক্রি করার বিষয়টা উপভোগ করেছি, আমরা এর মাধ্যমে বড়লোক হয়েছি, কিন্তু আমি এই কাজের মাধ্যমে আঁকার সুযোগ পেয়েছি এবং গবেষণার সময়টাও উপভোগ করেছি। এই সবগুলো বিষয় একত্রিত করার একটা মাধ্যম ছিল জালিয়াতি করা", ফিশারকে এমনটাই বলেছিলেন ওয়েফগাং।
'নিজ পরিচয় হারিয়ে ফেলা'
বেলট্রাকি জুটি এবং তাদের দুই সহকারীর বিরুদ্ধে ১৪টি শিল্পকর্ম জালিয়াতি করার অভিযোগ রয়েছে। সীমাবদ্ধতার বিধির কারণে আরও কয়েক ডজন এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেলট্রাকি জুটিরই দাবি,তারা প্রায় ৩০০ জাল শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন, যার মধ্যে অনেকগুলোই সেভাবে শনাক্তই করা হয়নি।
কিন্তু এই জাল শিল্পের পেছনেও রয়েছে তাদের দীর্ঘ অধ্যাবসায় এবং গবেষণা ও বিশদভাবে ফুটিয়ে তোলার প্রতি নেশা। তারা মূল শিল্পীদের কাজ বোঝার জন্য বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন, যেসব স্থানে শিল্পীরা তাদের বিখ্যাত চিত্রকর্ম এঁকেছেন সেগুলো ঘুরে দেখেছেন এবং জাদুঘরও পরিদর্শন করেছেন। এই ভ্রমণকে তারা 'কালচারাল ট্রিপস' বলে অভিহিত করেছেন। বিখ্যাত শিল্পীদের চিঠিপত্র ও ডায়েরিতে নিমজ্জিত থেকেছেন দিনের পর দিন এবং তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে বৃত্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করেছেন।
এইসব গবেষণার ফলে বেলট্রাকি জুটি তাদের চিত্রকর্মের পেছেন মিথ্যা ইতিহাসও সাজাতে পেরেছেন। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিত্রকর্মগুলো ওয়েফগাং এর কল্পনাপ্রসূত, কিন্তু এগুলোর শিরোনাম দেওয়া হতো বিখ্যাত শিল্পীদের পরিচিত কিন্তু হারিয়ে যাওয়া শিরোনাম অনুসারে (যে শিরোনামে আগের কোনো চিত্রকর্মের ছবি পাওয়া যায়নি)। আর এভাবেই তারা কোনোরকম সন্দেহের উদ্রেক না করেই শিল্পীদের শূন্যস্থান পূরণ করে যাচ্ছিলেন।
পুরাতন জিনিসপত্রের বাজার থেকে তারা ক্যানভাস এবং পুরনো ফ্রেম কিনে আনতেন। এমনকি ১৯২০-এর দশকের একটি ক্যামেরাও কিনেছিলেন তাদের চিত্রকর্মগুলোকে পুরনো আমলের দেখাতে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, বেলট্রাকি জুটির এই মামলার শুনানির সময় প্রিজাইডিং বিচারক বলেছিলেন- 'এই জালিয়াতি অসম্ভব রকম নিখুঁত উপায়ে করা হয়েছে'।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে ভিডিও কলে ফিশার বলেন, "তারা গল্পকথক, আর এজন্যেই তারা প্রচুর গবেষণা করেছে। তারা যেসব শিল্পীদের কাজ জালিয়াতি করেছে, তাদের সম্পর্কে সব তথ্য জানতো তারা।"
তিনি আরও যোগ করেন, "আমার মনে হয় এটা ওয়েফগাং এর সৃজনশীলতার একটা অংশ। আঁকাআঁকি শুরু করার আগে তাকে তাকে প্রচুর তথ্য জেনে নিতে হয়েছে এবং সে এমন সব চিত্রকর্ম এঁকেছে যেগুলো দেখলে আসল শিল্পীদের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ভাগের কাজ বলে ভুল হতে পারে।"
২০২২ সালে জার্মান নিউজ আউটলেট ডের স্পিগেল'কে ওয়েফগাং বলেছিলেন, তিনি প্রয়াত প্রায় ৫০ জন শিল্পীর কাজের ধরন অনুকরণ করতে শিখেছিলেন। তার স্টুডিও প্র্যাকটিস দেখলে মনে হয় তিনি পুরোপুরি এই শিল্পীদের জগতে নিমজ্জিত- এমন পর্যায়ে চলে গেছেন যে তিনি নিজস্ব পরিচয়ই হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে করেন ফিশার।
ওয়েফগাং মনে করেন যে, তার কাজের মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত শিল্পীদের পরিচয়কেই নকল করছেন। তার এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফিশার বলেন, "ওয়েফগাং এর নাম অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং অন্য ব্যক্তির মধ্য দিয়ে তার আবেগ প্রবাহিত হওয়ার মধ্যে একটা সম্পর্ক দাঁড় করিয়েছি আমি। সে দাবি করেছে যে সে অন্যদের অনুভূতিগুলো অনুভব করতে পারে।"
আর এই কাজের মাধ্যমেই ওয়েফগাং এক ধরনের সমানুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি সতেরো শতকের চিত্রশিল্পী হেনড্রিক এভারক্যাম্প এর এতটাই ঘনিষ্ঠ অনুভব করেছেন যে তিনি প্রথম এই শিল্পীর কাজ নকল করেছেন। ওয়েফগাং এর ভাষ্যে, হেনড্রিককে তার নিজের ভাইয়ের মতো মনে হতো! তিনি নিজেকে শিল্পীদের কাজের শূন্যস্থান পূরণের একটা মাধ্যম হিসেবে দেখতেন; তার মনে হতো তার সৃষ্ট শিল্পকর্মগুলো মূল কাজের পাশাপাশি অবদান রাখছে। ওয়েফগাং ফিশারকে বলেছেন যে, দৃশ্যটি আঁকার সময় তার খুবই সুখকর অনুভূতি হয়েছে।
ফিশার তার বইয়ে লিখেছেন, "ওয়েফগাং-এর নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে যাওয়ার কারণেই তিনি এই নকল কাজের মাধ্যমে একটা পরিচয় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।"
ভুক্তভোগীদের সন্ধানে
কিন্তু ওয়েফগাং নিজের কাজকে যতই যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা করেন না কেন, যাদের সাথে তিনি প্রতারণা করেছেন তাদের ক্ষেত্রে তার সেই সমানুভূতি একইভাবে কাজ করবে না। ব্যক্তিগত সংগ্রাহক থেকে শুরু করে নাম না জানা অনেক গ্যালারি ও মিউজিয়াম তার এই প্রতারণার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এমনকি কিছু কিছু জায়গায় হয়তো এখনও সেই নকল চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে।
আবার এই নকল শিল্পকর্মগুলোর কারণে অনেক বিশেষজ্ঞের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে। একজন ইতিহাসবিদ ওয়েফগাং এর আঁকা ছবিকে ভুলে ম্যাক্স এর্নস্ট এর কাজ বলে শনাক্ত করার পর তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সোথবি'স ও ক্রিস্টি'স এর মতো নিলাম হাউজগুলোও এই জুটির দ্বারা প্রতারিত হয়েছে।
কিন্তু ফিশারের মতে, বেলট্রাকি জুটি তাদের অপরাধের ফলে কাউকে ভুক্তভোগী হিসেবে দেখতেন না। ওয়েফগাং তাকে বলেছেন যেম তিনি শুধুমাত্র সুন্দর দেখতে এমন ছবিই আঁকেন এবং তার বিশ্বাস ছবিগুলোর মালিকদেরও এগুলো ভালো লেগেছে এবং এগুলোর মাধ্যমে তারা লাভও করেছেন।
বর্তমানে ওয়েফগাং এর একটি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট রয়েছে যেখানে তিনি তার গল্পকে 'রবিন হুড টেল' বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এই লোককাহিনীর এই হিরোর মতো ওয়েফগাং দরিদ্রদের সাহায্য করতে টাকা উপার্জন করেননি। বরং ফিশারকে তিনি বলেছেন এভাবে- "আমি দিনের পর দিন পুলের পাশে বসে থাকতাম, পড়তাম এবং দিবাস্বপ্ন দেখতাম আর ঘুমাতাম। যখনই টাকার প্রয়োজন হতো তখনই একটা নকল চিত্রকর্ম এঁকে বিক্রি করতাম।"
"বেলট্রাকি জুটি মনে করে শিল্প বাণিজ্য নিজেই একটা প্রতারণার জায়গা, তারা সেই বাণিজ্য নিয়েই আবার প্রতারণা করেছে। সবাই কেনার জন্য লোভী ছিল, তাই নিলাম হাউজ, এই জুটি, সব পক্ষই লাভ করেছে এখান থেকে। দিনশেষে বলা যায় যে সবাই খুশিই ছিল- এমনকি ক্রেতাও। বেলট্রাকিদের এই প্রতারণা যদি প্রকাশ না পেত, তাহলে তারা এই বাণিজ্য অব্যহতই রাখতো।
কিন্তু দিনশেষে, তাদের এই জালিয়াতি ফাঁস হয়েই গেছে; আর মামলার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক নকল ছবির মালিকদের ক্ষতিপূরণ চাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
২০১৪ সালে সিবিএস-এর 'সিক্সটি মিনিটস'লে ওয়েফগাং বলেন, আদালতের দেওয়া ক্ষতিপূরণ আরোপ ছাড়াও, তিনি ২৭ মিলিয়ন ডলারের মামলাও নিষ্পত্তি করেছেন।
এদিকে, ফিশার এখনও এই জুটির বন্ধু হিসেবে রয়ে গেছেন। এমনকি নিজের বইয়ের শুরুর পাতায় এই জুটিকেই উৎসর্গও করেছেন। নৈতিকতার দিক থেকে কাউকে বিচার করতে যাননি ফিশার, বরং এ ঘটনার একটি সাইকোঅ্যানালাইসিস করেছেন তিনি এবং অভিযুক্তদের মনের গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
বিশেষ করে তিনি ওয়েফগাং এর বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিয়ে জেনেছেন, বুঝতে চেয়েছেন যে এমন একজন দক্ষ জালিয়াত হয়ে ওঠার পেছনে সেই পরিবেশের ভূমিকা আছে কিনা। জানা যায়, ওয়েফগাং এর বাবা ছিলেন একজন শিল্পী এবং বাবাকে সাহায্য করতে করতেই শিল্পের দিকে ঝোঁক তার। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি পিকাসোর শুরুর দিকের একটি চিত্রকর্ম নকল করেন এবং এতে নিজস্ব উপাদান যোগ করেন। আর এভাবেই আঁকার দক্ষতায় বাবাকেও ছাড়িয়ে যান ওয়েফগাং।
ফিশারের সাথে ওয়েফগাং এর আলাপচারিতায় জানা যায়, ওয়েফগাং-এর বাবা-মা দুজনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় ভীষণ 'বিপর্যস্ত' ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীণ তার মা সন্তানদের নিয়ে জার্মানির গ্রামাঞ্চলে চলে যান এবং তার বাবা পশ্চিম রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেন। পরে ফ্রান্সে চার বছর যুদ্ধবন্দী হিসেবে কাটান তিনি।
ফিশার লিখেছেন, "বাবা-মায়ের এই দুঃখ ও দুর্দশা সন্তানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ওয়েফগাং তার বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সন্তানদেরও নিশ্চিন্তে, সুখে-স্বচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ ছিল না।"
এমতাবস্থায় 'সারভাইভার'স গিল্ট' অনুভব হতে পারে, বলেন ফিশার। অর্থাৎ, সন্তানরা বাবা মায়ের এই দুর্দশা দেখে নিজেরা স্বচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করাটাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে মনে করতে পারে। মৃত শিল্পীদের এবং অন্যদের পরিচয় নিজের মধ্যে নিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ওয়েফগাং এই 'ইমোশনাল বার্ডেন' বা আবেগজনিত চাপ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন।
"সে হারিয়ে গেছে, তবুও সে আছে... সে সৃজনশীল, স্বায়ত্তশাসিত, ধনী এবং নিষ্পাপ। সে নিজের বাবা মায়ের প্রতি যে অপরাধবোধ অনুভব করে, তার আসল নাম হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই অপরাধবোধও দূর হয়ে যায়। একজন 'কেউ না'- এমন ব্যক্তির তো অপরাধবোধ থাকতে পারে না- তার তো অস্তিত্বই নেই, তাই সে যেকোনো কিছু করতে পারে", বলেন ফিশার।
ওয়েফগাং বেলট্রাকি ও হেলেন বেলট্রাকি- এই জার্মান দম্পতি তাদের নকল চিত্রকর্মের জন্য হোয়াইট পেইন্ট তৈরিতে যে জিংক ব্যবহার করতেন, একদিন তা ফুরিয়ে যাওয়ার পর ওয়েফগাং একজন ডাচ প্রস্তুতকারকের কাছ থেকে জিংক পিগমেন্ট কিনেছিলেন। কিন্তু সেই বিক্রেতা তাকে জানাননি যে এতে টাইটানিয়াম রয়েছে।
পরের বছর ওয়েফগাং তার একটি নকল শিল্পকর্ম 'রেড পিকচার উইথ হর্সেস'কে বিখ্যাত এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী হাইনরিখ কাম্পেনডোংকের শিল্পকর্ম বলে চালিয়ে দেন এবং নিলামে রেকর্ড ২.৮ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করেন। আর এখানেই একটি অসঙ্গতি ধরা পড়ে। চিত্রকর্মটি বিশ্লেষণ করে এতে টাইটানিয়ামের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, কিন্তু এই পদার্থটি হোয়াইট পিগমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয় ১৯২০-এর দশক থেকে। অথচ হাইনরিখের ওই চিত্রকর্মটি ১৯১৪ সালের বলে বিবেচিত।
এই চিত্রকর্মটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরপরই একের পর এক ঘটনার সত্য উন্মোচন হতে থাকে যে কিভাবে বেলট্রাকি দম্পতি সারা বিশ্বের বাঘা বাঘা ধনকুবের এবং গ্যালারিগুলোকে বোকা বানিয়ে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে চলেছেন। ওয়েফগাং-এর পেইন্টিংগুলো নিলাম হাউজ থেকে শুরু করে অভিনেতা স্টিভ মার্টিনের মতো শিল্প সংগ্রাহকদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে স্থান পেয়েছিল। এমনকি বেলট্রাকি দম্পতি একজন বিশেষজ্ঞ শিল্প মূল্যায়নকারীকে ধোঁকা দিয়েছেন- কিংবা প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে তার মুখ বন্ধ রেখেছেন।
২০১৪ সালে জার্মানির মোরিটজবুর্গ আর্ট মিউজিয়ামে ওয়েফগাং এর আঁকা নকল শিল্পকর্ম 'টু রেড হর্সেস ইন ল্যান্ডস্কেপ' দেখছেন এক নারী। ছবি: পিটার এনডিগ/পিকচার এলায়েন্স/গেটি ইমেজেসে
প্রায় ৩০ বছর ধরে এই প্রতারণামূলক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পর ২০১১ সালে ওয়েফগাং ও হেলেন বেলট্রাকিকে ৬ বছরের কারাদণ্ড এবং এর মধ্যে ৪ বছর কারাগারে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও পরে তাদেরকে সাজার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কিছুটা আগেভাগেই ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও, ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩৫ মিলিয়ন ইউরো পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয় তাদেরকে।
বিদ্যমান পেইন্টিংগুলো জাল করার পরিবর্তে ওয়েফগাং নিজেই শত শত নতুন চিত্রকর্ম এঁকেছেন যেগুলোতে ম্যাক্স এর্নস্ট, ফের্নো লিজে, কেইস ফন দোগেন ও অঁদ্রে ডেরার মতো প্রয়াত ইউরোপিয়ান শিল্পীদের কাজের ধরন সুনিপুণভাবে অনুকরণ করেছেন তিনি। তার স্ত্রী হেলেন এগুলোকে পূর্বে নথিভুক্ত করা হয়নি-এমন শিল্পকর্ম হিসেবে বিক্রি করেছেন, কখনো কখনো চোখ ধাঁধানো দামে। এই জুটি দাবি করেছেন যে, হেলেনের দাদি হিটলারের সময় জার্মানি ত্যাগ করা এক ইহুদি গ্যালারিস্টের কাছ থেকে এই শিল্পকর্মগুলো সংগ্রহ করেছিলেন এবং তার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো পেয়েছেন তারা।
কিন্তু তাদের এই দাবি যে আগাগোড়া মিথ্যা এবং তাদের প্রতারণার বিস্তারিত তথ্য একাধিক পত্রপত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছে। সেইসঙ্গে একটি প্রামাণ্যচিত্র এবং ২০১১ সালে তাদের মামলায় শুনানিতেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে সাইকোঅ্যানালিস্ট জ্যানেট ফিশার গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যে কেন বেলট্রাকি জুটি এই বিশাল প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন। বেলট্রাকি জুটি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুইজারল্যান্ডে তাদের স্টুডিওতে বসে কফি কিংবা ওয়াইন পান করতে করতে তাদের সঙ্গে একাধিকবার আলাপচারিতায় বসেছিলেন জ্যানেট। আর এই আলাপচারিতার মাধ্যমেই তিনি তাদের এই জালিয়াতির উদ্দেশ্য, শৈল্পিক প্রক্রিয়া ও পারিবারিক ইতিহাস বের করার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু ফলাফলে এমন একজন মানুষের জটিল চিত্র উঠে আসে যার কাছে এই প্রতারণা শিল্পেরই একটি সৃজনশীল রূপ! ওয়েফগাংকে নিয়েই মূলত বইটি লেখা হয়েছে, যার কাছে এই প্রতারণা একটা খেলার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি ও তার স্ত্রী হেলেন এই জালিয়াতির মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিলেও, টাকা এখানে তাদের কাছে মূল আকর্ষণ ছিল না বলে বলছেন ফিশার। যদিও এই জুটি সেই টাকা দিয়ে বেশ সচ্ছল জীবনযাপনই করেছেন, বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেছেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সে একটা বাড়িও কিনেছেন; কিন্তু বিপুল পরিমাণ টাকা তাদের হাতে থাকা সত্ত্বেও তারা অনেক ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি করেননি।
"এই জালিয়াতি ঘটনাক্রমে হয়েছে বলা যায়। আমরা এই চিত্রকর্মগুলো বিক্রি করার বিষয়টা উপভোগ করেছি, আমরা এর মাধ্যমে বড়লোক হয়েছি, কিন্তু আমি এই কাজের মাধ্যমে আঁকার সুযোগ পেয়েছি এবং গবেষণার সময়টাও উপভোগ করেছি। এই সবগুলো বিষয় একত্রিত করার একটা মাধ্যম ছিল জালিয়াতি করা", ফিশারকে এমনটাই বলেছিলেন ওয়েফগাং।
'নিজ পরিচয় হারিয়ে ফেলা'
বেলট্রাকি জুটি এবং তাদের দুই সহকারীর বিরুদ্ধে ১৪টি শিল্পকর্ম জালিয়াতি করার অভিযোগ রয়েছে। সীমাবদ্ধতার বিধির কারণে আরও কয়েক ডজন এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেলট্রাকি জুটিরই দাবি,তারা প্রায় ৩০০ জাল শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন, যার মধ্যে অনেকগুলোই সেভাবে শনাক্তই করা হয়নি।
কিন্তু এই জাল শিল্পের পেছনেও রয়েছে তাদের দীর্ঘ অধ্যাবসায় এবং গবেষণা ও বিশদভাবে ফুটিয়ে তোলার প্রতি নেশা। তারা মূল শিল্পীদের কাজ বোঝার জন্য বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন, যেসব স্থানে শিল্পীরা তাদের বিখ্যাত চিত্রকর্ম এঁকেছেন সেগুলো ঘুরে দেখেছেন এবং জাদুঘরও পরিদর্শন করেছেন। এই ভ্রমণকে তারা 'কালচারাল ট্রিপস' বলে অভিহিত করেছেন। বিখ্যাত শিল্পীদের চিঠিপত্র ও ডায়েরিতে নিমজ্জিত থেকেছেন দিনের পর দিন এবং তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে বৃত্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করেছেন।
এইসব গবেষণার ফলে বেলট্রাকি জুটি তাদের চিত্রকর্মের পেছেন মিথ্যা ইতিহাসও সাজাতে পেরেছেন। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিত্রকর্মগুলো ওয়েফগাং এর কল্পনাপ্রসূত, কিন্তু এগুলোর শিরোনাম দেওয়া হতো বিখ্যাত শিল্পীদের পরিচিত কিন্তু হারিয়ে যাওয়া শিরোনাম অনুসারে (যে শিরোনামে আগের কোনো চিত্রকর্মের ছবি পাওয়া যায়নি)। আর এভাবেই তারা কোনোরকম সন্দেহের উদ্রেক না করেই শিল্পীদের শূন্যস্থান পূরণ করে যাচ্ছিলেন।
পুরাতন জিনিসপত্রের বাজার থেকে তারা ক্যানভাস এবং পুরনো ফ্রেম কিনে আনতেন। এমনকি ১৯২০-এর দশকের একটি ক্যামেরাও কিনেছিলেন তাদের চিত্রকর্মগুলোকে পুরনো আমলের দেখাতে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, বেলট্রাকি জুটির এই মামলার শুনানির সময় প্রিজাইডিং বিচারক বলেছিলেন- 'এই জালিয়াতি অসম্ভব রকম নিখুঁত উপায়ে করা হয়েছে'।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে ভিডিও কলে ফিশার বলেন, "তারা গল্পকথক, আর এজন্যেই তারা প্রচুর গবেষণা করেছে। তারা যেসব শিল্পীদের কাজ জালিয়াতি করেছে, তাদের সম্পর্কে সব তথ্য জানতো তারা।"
তিনি আরও যোগ করেন, "আমার মনে হয় এটা ওয়েফগাং এর সৃজনশীলতার একটা অংশ। আঁকাআঁকি শুরু করার আগে তাকে তাকে প্রচুর তথ্য জেনে নিতে হয়েছে এবং সে এমন সব চিত্রকর্ম এঁকেছে যেগুলো দেখলে আসল শিল্পীদের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ভাগের কাজ বলে ভুল হতে পারে।"
২০২২ সালে জার্মান নিউজ আউটলেট ডের স্পিগেল'কে ওয়েফগাং বলেছিলেন, তিনি প্রয়াত প্রায় ৫০ জন শিল্পীর কাজের ধরন অনুকরণ করতে শিখেছিলেন। তার স্টুডিও প্র্যাকটিস দেখলে মনে হয় তিনি পুরোপুরি এই শিল্পীদের জগতে নিমজ্জিত- এমন পর্যায়ে চলে গেছেন যে তিনি নিজস্ব পরিচয়ই হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে করেন ফিশার।
ওয়েফগাং মনে করেন যে, তার কাজের মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত শিল্পীদের পরিচয়কেই নকল করছেন। তার এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফিশার বলেন, "ওয়েফগাং এর নাম অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং অন্য ব্যক্তির মধ্য দিয়ে তার আবেগ প্রবাহিত হওয়ার মধ্যে একটা সম্পর্ক দাঁড় করিয়েছি আমি। সে দাবি করেছে যে সে অন্যদের অনুভূতিগুলো অনুভব করতে পারে।"
আর এই কাজের মাধ্যমেই ওয়েফগাং এক ধরনের সমানুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি সতেরো শতকের চিত্রশিল্পী হেনড্রিক এভারক্যাম্প এর এতটাই ঘনিষ্ঠ অনুভব করেছেন যে তিনি প্রথম এই শিল্পীর কাজ নকল করেছেন। ওয়েফগাং এর ভাষ্যে, হেনড্রিককে তার নিজের ভাইয়ের মতো মনে হতো! তিনি নিজেকে শিল্পীদের কাজের শূন্যস্থান পূরণের একটা মাধ্যম হিসেবে দেখতেন; তার মনে হতো তার সৃষ্ট শিল্পকর্মগুলো মূল কাজের পাশাপাশি অবদান রাখছে। ওয়েফগাং ফিশারকে বলেছেন যে, দৃশ্যটি আঁকার সময় তার খুবই সুখকর অনুভূতি হয়েছে।
ফিশার তার বইয়ে লিখেছেন, "ওয়েফগাং-এর নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে যাওয়ার কারণেই তিনি এই নকল কাজের মাধ্যমে একটা পরিচয় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।"
ভুক্তভোগীদের সন্ধানে
কিন্তু ওয়েফগাং নিজের কাজকে যতই যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা করেন না কেন, যাদের সাথে তিনি প্রতারণা করেছেন তাদের ক্ষেত্রে তার সেই সমানুভূতি একইভাবে কাজ করবে না। ব্যক্তিগত সংগ্রাহক থেকে শুরু করে নাম না জানা অনেক গ্যালারি ও মিউজিয়াম তার এই প্রতারণার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এমনকি কিছু কিছু জায়গায় হয়তো এখনও সেই নকল চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে।
আবার এই নকল শিল্পকর্মগুলোর কারণে অনেক বিশেষজ্ঞের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে। একজন ইতিহাসবিদ ওয়েফগাং এর আঁকা ছবিকে ভুলে ম্যাক্স এর্নস্ট এর কাজ বলে শনাক্ত করার পর তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সোথবি'স ও ক্রিস্টি'স এর মতো নিলাম হাউজগুলোও এই জুটির দ্বারা প্রতারিত হয়েছে।
কিন্তু ফিশারের মতে, বেলট্রাকি জুটি তাদের অপরাধের ফলে কাউকে ভুক্তভোগী হিসেবে দেখতেন না। ওয়েফগাং তাকে বলেছেন যেম তিনি শুধুমাত্র সুন্দর দেখতে এমন ছবিই আঁকেন এবং তার বিশ্বাস ছবিগুলোর মালিকদেরও এগুলো ভালো লেগেছে এবং এগুলোর মাধ্যমে তারা লাভও করেছেন।
বর্তমানে ওয়েফগাং এর একটি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট রয়েছে যেখানে তিনি তার গল্পকে 'রবিন হুড টেল' বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এই লোককাহিনীর এই হিরোর মতো ওয়েফগাং দরিদ্রদের সাহায্য করতে টাকা উপার্জন করেননি। বরং ফিশারকে তিনি বলেছেন এভাবে- "আমি দিনের পর দিন পুলের পাশে বসে থাকতাম, পড়তাম এবং দিবাস্বপ্ন দেখতাম আর ঘুমাতাম। যখনই টাকার প্রয়োজন হতো তখনই একটা নকল চিত্রকর্ম এঁকে বিক্রি করতাম।"
"বেলট্রাকি জুটি মনে করে শিল্প বাণিজ্য নিজেই একটা প্রতারণার জায়গা, তারা সেই বাণিজ্য নিয়েই আবার প্রতারণা করেছে। সবাই কেনার জন্য লোভী ছিল, তাই নিলাম হাউজ, এই জুটি, সব পক্ষই লাভ করেছে এখান থেকে। দিনশেষে বলা যায় যে সবাই খুশিই ছিল- এমনকি ক্রেতাও। বেলট্রাকিদের এই প্রতারণা যদি প্রকাশ না পেত, তাহলে তারা এই বাণিজ্য অব্যহতই রাখতো।
কিন্তু দিনশেষে, তাদের এই জালিয়াতি ফাঁস হয়েই গেছে; আর মামলার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক নকল ছবির মালিকদের ক্ষতিপূরণ চাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
২০১৪ সালে সিবিএস-এর 'সিক্সটি মিনিটস'লে ওয়েফগাং বলেন, আদালতের দেওয়া ক্ষতিপূরণ আরোপ ছাড়াও, তিনি ২৭ মিলিয়ন ডলারের মামলাও নিষ্পত্তি করেছেন।
এদিকে, ফিশার এখনও এই জুটির বন্ধু হিসেবে রয়ে গেছেন। এমনকি নিজের বইয়ের শুরুর পাতায় এই জুটিকেই উৎসর্গও করেছেন। নৈতিকতার দিক থেকে কাউকে বিচার করতে যাননি ফিশার, বরং এ ঘটনার একটি সাইকোঅ্যানালাইসিস করেছেন তিনি এবং অভিযুক্তদের মনের গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
বিশেষ করে তিনি ওয়েফগাং এর বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিয়ে জেনেছেন, বুঝতে চেয়েছেন যে এমন একজন দক্ষ জালিয়াত হয়ে ওঠার পেছনে সেই পরিবেশের ভূমিকা আছে কিনা। জানা যায়, ওয়েফগাং এর বাবা ছিলেন একজন শিল্পী এবং বাবাকে সাহায্য করতে করতেই শিল্পের দিকে ঝোঁক তার। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি পিকাসোর শুরুর দিকের একটি চিত্রকর্ম নকল করেন এবং এতে নিজস্ব উপাদান যোগ করেন। আর এভাবেই আঁকার দক্ষতায় বাবাকেও ছাড়িয়ে যান ওয়েফগাং।
ফিশারের সাথে ওয়েফগাং এর আলাপচারিতায় জানা যায়, ওয়েফগাং-এর বাবা-মা দুজনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় ভীষণ 'বিপর্যস্ত' ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীণ তার মা সন্তানদের নিয়ে জার্মানির গ্রামাঞ্চলে চলে যান এবং তার বাবা পশ্চিম রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেন। পরে ফ্রান্সে চার বছর যুদ্ধবন্দী হিসেবে কাটান তিনি।
ফিশার লিখেছেন, "বাবা-মায়ের এই দুঃখ ও দুর্দশা সন্তানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ওয়েফগাং তার বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সন্তানদেরও নিশ্চিন্তে, সুখে-স্বচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ ছিল না।"
এমতাবস্থায় 'সারভাইভার'স গিল্ট' অনুভব হতে পারে, বলেন ফিশার। অর্থাৎ, সন্তানরা বাবা মায়ের এই দুর্দশা দেখে নিজেরা স্বচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করাটাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে মনে করতে পারে। মৃত শিল্পীদের এবং অন্যদের পরিচয় নিজের মধ্যে নিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ওয়েফগাং এই 'ইমোশনাল বার্ডেন' বা আবেগজনিত চাপ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন।
"সে হারিয়ে গেছে, তবুও সে আছে... সে সৃজনশীল, স্বায়ত্তশাসিত, ধনী এবং নিষ্পাপ। সে নিজের বাবা মায়ের প্রতি যে অপরাধবোধ অনুভব করে, তার আসল নাম হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই অপরাধবোধও দূর হয়ে যায়। একজন 'কেউ না'- এমন ব্যক্তির তো অপরাধবোধ থাকতে পারে না- তার তো অস্তিত্বই নেই, তাই সে যেকোনো কিছু করতে পারে", বলেন ফিশার।
তবে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর এখন নিজের নামেই নিজ শিল্পকর্ম তৈরি করছেন ওয়েফগাং। আর অতীতের এই আকর্ষণীয় গল্প থেকে তো লাভ হচ্ছেই। প্রায়ই তাকে নানা ইভেন্টে দেখা যায় এবং ২০২১ সালে বেশকিছু এনএফটি ছেড়েছেন তিনি, যেখানে তিনি ভিঞ্চির 'সালভাতর মুন্ডি'কে পুনরায় অ্যান্ডি ওয়ারহল ও ভ্যান গখের মতো শিল্পীদের মতো করে কল্পনা করেছেন।
Post a Comment