জাপানে, বিব্রত কর্মচারীরা এজেন্সিকে টাকা দিচ্ছেন তাদের হয়ে চাকরি ছাড়ার ব্যবস্থা করতে

 


ODD বাংলা ডেস্ক: কয়েক বছর আগে তোশিয়ুকি নিনো তার চাকরি ছাড়তে চেয়েছিলেন কারণ ওই কর্মস্থল তার ভালো লাগতো না এবং সেখানে কাজ করে তিনি খুশি ছিলেন না। কিন্তু চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দেখলেন যে তিনি বসের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন এবং তার সাহসে কুলোচ্ছে না বসের মুখোমুখি হতে।


জাপানেই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আসা নিনো জানতেন যে তার এই সিদ্ধান্তে বস মোটেও খুশি হবেন না এবং বিপরীত দিক থেকে এক ধরনের বাধা আসবেই।


"যখন আপনি চাকরি ছাড়ার চেষ্টা করবেন, তারা এমন কিছু করবে যে আপনি নিজেই অপরাধবোধে ভুগবেন। তারপর তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে চাকরি ছাড়ছেন বলে তারা আপনাকে লজ্জিত অনুভব করাবে। আমি এটা নিয়ে খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি", সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন কামাকুরার বাসিন্দা নিনো।


নিনোর এই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তার এবং তার বাল্যকালের বন্ধু ইয়ুইচিরো ওকাজাকির মাথায় একটা আইডিয়া আসে: কেমন হবে যদি চাকরি ছাড়ার পুরো প্রক্রিয়াটা আপনার বদলে আপনার হয়ে অন্য কেউ সম্পন্ন করে?


এই চিন্তা থেকেই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান 'এক্সিট' প্রতিষ্ঠা করেন তারা। জাপানি কর্মীদের মধ্যে যারা চাকরি ছাড়ার বিষয়ে খুব বিব্রত বা লজ্জিতবোধ করেন, তাদের হয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়ার কাজটি করবে এই প্রতিষ্ঠানটি।


২০,০০০ ইয়েনের (১৪৪ ডলার) বিনিময়ে এক্সিট নামক এই প্রতিষ্ঠান তাদের ক্লায়েন্টের নিয়োগকর্তাকে জানাবে যে তার একজন কর্মী চাকরি ছাড়তে চান। এর ফলে ওই কর্মীটি তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মুখোমুখি হওয়ার মতো উদ্বেগ সৃষ্টিকারী প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে পারে।


২০১৭ সালে এক্সিট লঞ্চ হওয়ার পর থেকে তাদের এই ব্যবসায়িক মডেলটি অনুসরণ করেছে জাপানের আরও দুই ডজনের মতো কোম্পানি এবং এটিকে কেন্দ্র করে জাপানে 'রেজিগনেশন আউটসোর্সিং' এর একটি শিল্প গড়ে উঠেছে। এই অভিনব সেবা দেওয়ার মাধ্যমে জাপানের বহু কর্মীর মন জয় করে নিয়েছে তারা।


নিনো জানান, তার বেশিরভাগ ক্লায়েন্টই বিশের কোঠায় থাকা পুরুষেরা এবং প্রতি বছর তার এখানে ১০ হাজারের বেশি জিজ্ঞাসা আসে। যদিও এদের সবাই-ই যে শেষ পর্যন্ত তাদের সেবা নেন তা নয়। 


"দুটি প্রধান কারণ হলো, কর্মীরা তাদের বসকে এতটাই ভয় পায় যে বসের সামনে গিয়ে চাকরি ছাড়ার কথা বলতে পারে না এবং দ্বিতীয়টি হলো, চাকরি ছাড়তে চাইছে বলে তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া অপরাধবোধ", বলেন নিনো।


নিনো মনে করেন, তাদের এই পরিষেবাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সঙ্গে জাপানি সংস্কৃতির কিছু দিকের সম্পর্ক রয়েছে। এই সংস্কৃতিতে কাজের ছন্দে ব্যাঘাত ঘটানোকে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং সফলতা লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকাকে উৎসাহিত করা হয়।


"বিষয়টা অনেকটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আপনি যদি ছেড়ে দেন চাকরি বা একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ না করেন, যেন একটা পাপ করে ফেলেছেন! তখন মনে করা হয় যেন আপনি খুব খারাপ একটা ভুল করে ফেলেছেন", বলেন নিনো।


বিংশ শতাব্দীজুড়ে জাপানের রীতিই ছিল এরকম যে আজীবন একই কাজের প্রতি চুক্তিবদ্ধ থাকতে হবে। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও দীর্ঘ পরিষেবা প্রদানের ক্লান্তিকর 'কর্মসংস্কৃতি'র জন্য জাপানের পরিচিতি রয়েছে।


অতিরিক্ত কাজের চাপে মৃত্যু- এটি বোঝাতে ১৯৭০ এর দশকে 'কারোশি' নামক একটি টার্ম প্রচলন করা হয়। প্রতি বছর শত শত মানুষের কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যু ও আত্মহত্যার কারণ হিসেবে অফিসিয়ালি এই টার্মটিকে চিহ্নিত করা হয়।


জাপানের আজীবন একটি চাকরিতে থাকার প্রথাগত রীতি বিগত কয়েক দশকে দুর্বল হয়ে এলেও, জাপানি কর্মীরা এখনও খুব কমই চাকরি পরিবর্তন করেন; অন্যান্য দেশে তাদের সমমর্যাদার কর্মীদের তুলনায় তারা বরং জ্যেষ্ঠতা-ভিত্তিক বেতন (সিনিয়রিটি বেইজড পে) এর উপর নির্ভর করেন।


২০১৯ সালে একটি জাপানি কোম্পানিতে সার্ভিস প্রদানের গড় সময়কাল ছিল ১২.৪ বছর, ওসিইডি গড় হিসেবে যা ১০.১ বছর। ২০১৮ সালে ওসিইডি'র এক গবেষণায় দেখা গেছে, জাপানে একই কোম্পানিতে অন্তত ২০ বছর কাজ করলে ওয়েজ প্রিমিয়াম বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ; আর শীর্ষস্থানে থাকা বাকি দুটি দেশ হলো তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া।


'এক্সিট' নামক প্রতিষ্ঠানটি জাপানে এক নতুন শিল্প গড়ে ওঠার পথপ্রদর্শক হলেও, সবাই যে তাদের পরিষেবার দিকটি নিয়ে খুশি- এমনটা নয়।


টোকিওর একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির ম্যানেজার কোজি তাকাহাশি জানান, একটি এজেন্সি যখন তাকে কল দিয়ে জানাল যে তার প্রতিষ্ঠানে কয়েকদিন কাজ করার পরেই এক জুনিয়র কর্মী চাকরি ছাড়তে চাইছেন, তখন তিনি এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি ঐ কর্মীর মা-বাবাকে কল দিয়েছিলেন খবরটা নিশ্চিত হতে!


"আমি তার মা-বাবাকে আমার বিজনেস কার্ড দিয়েছিলাম। নিজেকে কোম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে পুরো পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলেছিলাম যে তাদের ছেলে সদ্য আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। আমি আরও বলেছিলাম যে আমি এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবো, কিন্তু আমি চাই ওই কর্মী তার নিরাপত্তার খাতিরেই আমার সঙ্গে সরাসরি এসে কথা বলুক।"


তাকাহাশি বলেন, কর্মী তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানাতে 'রেজিগনেশন আউটসোর্সিং এজেন্সি' ব্যবহার করায় তার নিজের চরিত্র সম্পর্কে তার মনোভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।


"আমি ভেবেছিলাম কেউ যদি এ ধরনের এজেন্সির সেবা না নিয়ে পদত্যাগ করতে না পারে, তাহলে সেটা তার নিজেরই ক্ষতি এবং তারা এমনই দুর্ভাগা যে তাদের কাছে চাকরি মানে স্রেফ টাকা উপার্জনের একটা মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়",বলেন তাকাহাশি।


নিনো জানান, তার এই ব্যবসায়িক উদ্যোগ কিছু কিছু নিয়োগকর্তার কাছ থেকে শীতল অভ্যর্থনা পেয়েছে। কিন্তু অন্যরা তাদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ সম্পর্কে সত্যিকার ফিডব্যাক পেয়ে কৃতজ্ঞ।


"সাধারণত কর্মীরা চাকরি ছাড়ার আসল কারণ বলতে চায় না; উদাহরণস্বরূপ- তারা হয়তো বসকে পছন্দই করে না", বলেন তিনি।


"সাধারণত তারা কোনো দুর্বল অজুহাত দেখায় যে তাদেরকে পরিবারের যত্ন নেওয়ার পেছনে সময় দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের পরিষেবার মাধ্যমে কর্মীরা তাদের চাকরি ছাড়ার সত্যিকার কারণ জানাতে পারেন", যোগ করেন নিনো।


নিনো মনে করেন, জাপানিরা যদি স্বকীয়তা বজায় রাখার দিকে বেশি মনোযোগী হন, তাহলে সেটা খুবই আদর্শ কাজ হবে। কিন্তু জাপানের 'বদ্ধ সমাজে', যেখানে ছন্দ বজায় রাখাই প্রধান বিষয়- সেখানে এটা কঠিন হবে বলেই তার ধারণা।


কিন্তু যতদিন পর্যন্ত এই পরিবর্তন না আসছে, ততদিন পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠানের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যবান সমাজসেবা করে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।


নিনো বলেন, "কিছু কিছু ক্লায়েন্ট জানিয়েছেন, যে কোম্পানিতে ছিলেন সেখানে কাজ করার কথা ভেবে তাদের আত্মঘাতী চিন্তাও আসতো, কিন্তু আমাদের এজেন্সি তাদেরকে সাহায্য করার পর এ ধরনের চিন্তা আর আসেনি। লোকজন আমাদের অনেক প্রশংসা করেছে।"


তিনি আরও যোগ করেন, "আমাদের জগতটাকে বদলে দেওয়া বা ঠিক করে ফেলা অত সহজ নয়। আমরা ছয় বছর ধরে এই কোম্পানি চালাচ্ছি এবং প্রতি বছর আমাদের ক্লায়েন্টের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর মানে, পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। আমার মনে হয় না আগামী ১০০ বছরেও তা পরিবর্তন হবে।"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.