ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী বীরকন্যা: জোয়ান অব আর্ক



 ODD বাংলা ডেস্ক: পরাধীন ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী বীরকন্যা এবং রূপকথাতুল্য এক নেত্রী জান্ দার্ক(Jeanne ď Arc)। যিনি ইংরেজিতে Joan Of Arc নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে জোয়ান অব আর্ক এক প্রেরণার নাম। মৃত্যুর সাড়ে তিনশ’ বছর পর তিনি ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীকে পরিণত হন। তিনি ফরাসি দেশের অভিভাবক-সন্তের মর্যাদা পান। তার স্মরণে ফ্রান্সে অনেক স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।

ইতিহাসে সেইন্ট জোয়ান অব আর্ক এর আবির্ভাব ঘটে এক অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়ে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা।  সে সময় ফ্রান্স এবং ইংরেজদের মাঝে  শতবর্ষের যুদ্ধ চলছে। ইংরেজদের আক্রমণে বিপর্যস্ত ফ্রান্স। সৈন্যহীন, শক্তিহীন যুবরাজ ডফিন পিছনে সরতে সরতে ফ্রান্সের দক্ষিণ চিনন শহরে আশ্রয় নিলেন। পরাজয় যখন অনিবার্য, সে সময় আকষ্মিকভাবেই পুরুষের পোশাক পরিহিত এক কিশোরী এসে উপস্থিত। তিনি ফ্রান্সের যুবরাজের সামনে হাজির হয়ে দাবি করেন, স্বয়ং ঈশ্বরের প্রেরিত বার্তায় তাকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করার সংকেত দেয়া হয়েছে। মুকুটহীন রাজা সপ্তম চার্লস তাকে অরলিয়েন্স এর অবরোধ ক্ষেত্রে পাঠান। মাত্র ৯ দিনে অবরোধ উত্তোলন করতে পেরে তিনি বিরাট স্বীকৃতি লাভ করেন। পরপর বেশ দ্রুত কয়েকটি জয়ের পর তিনি সপ্তম চার্লসকে নিয়ে রাজ্যাভিষেকের উদ্দেশ্যে রেইমসে যাত্রা করেন। মাত্র সতের বছর বয়সে একটি জাতির পুরো সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দান করার কৃতিত্ব ইতিহাসে একমাত্র তারই আছে। দীর্ঘদিন গলা ও মাথায় আঘাতের ক্ষত নিয়েও তিনি দেশকে বারবার জয়ী করেন।


ফরাসী কবি ল্যামারটাইন বলেছেন, জোয়ান এক দিকে বীরাঙ্গনা অন্যদিকে সন্ন্যাসিনী একদিকে ফ্রান্সের গৌরব। 


জোয়ান অব আর্ক ১৪১২ সালের ৬ জানুয়ারি ফ্রান্সের মিউজ নদীর তীরে দঁরেডোমাঁয়েইমি গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জোয়ান লেখাপড়া জানতেন না। ভাইদের সাথে খামারের গবাদিপশুর দেখাশোনা আর সুই সুতোর খেলাতেই কেটে যেত সময়। তবে মাত্র সতের বছর বয়সেই তার মনোজগতে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দেয়। যুদ্ধে কোণঠাসা ফ্রান্সের অবস্থা তাকে বিচলিত করে। যদিও  গ্রামের মেয়ে যুদ্ধে যেতে চায় শুনে প্রথমে সবাই বাধা দিলেন। বাবা মা কত বোঝালেন, কিন্তু জোয়ান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার এই সিদ্ধান্তে  পাশে ছিলেন একমাত্র কাকা।  


পরবর্তীতে কাকা আর ভাইকে নিয়ে সেনাপতি রবার্টের দুর্গের দিকে যাত্রা করলেন জোয়ান। সেনাপতি তাকে অবিশ্বাস করলেও জোয়ানের সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা আর কথায় যুবরাজ ডফিনের বিশ্বাস হলো। এর পরেই জোয়ান পুরুষ নাইটদের পোশাক পরিধান করে একটি কালো ঘোড়ায় চড়ে সাদা পতাকা ও পঞ্চক্রুশধারী তরবারি হাতে ৪০০০ সৈন্য নিয়ে অর্লিয়েনসের দিকে প্রবেশ করে।


জোয়ান আর তার সৈন্যের আক্রমণাত্মক কৌশল অবলম্বন করাই ইংরেজ সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই তাদের একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা ইংরেজ সৈন্যদের কবল থেকে তুরেলবুরুজ শহর উদ্ধার করেন। এর পর পাতে’র যুদ্ধেও ইংরেজরা পরাজিত হয়। মরণপণ লড়াইয়ের পর জয়ী হয়ে যুবরাজ ডফিনের রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন জোয়ান। এই বিজয়ে ডফিন তার পরিষদ নিয়ে অপেক্ষাতেই ছিলেন। জোয়ানের অসামান্য সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য ফ্রান্সের রাজসভায় অভিনন্দনের জোয়ার বয়ে গেলেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন জোয়ান। যুদ্ধের বিভৎসতা তাঁকে মানসিকভাবে আহত করে। এত মৃত্যু এত রক্ত তিনি সইতে পারলেন না। এ ঘটনার পর ফ্রান্সের প্রাচীন রেইম শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে যুবরাজ ডফিনকে সম্রাট ঘোষণা করে তার নতুন নামকরণ করা হয় সপ্তম চার্লস।


যুদ্ধে সফলতার পর জোয়ান রাজ্য থেকে  বিদায় নিতে চাইলেন। তিনি সম্রাটকে বোঝালেন সবুজ বনানীতে ঘেরা গ্রাম তাকে ডাকছে। সে তার মা-বাবা-ভাইদের কাছে তিনি ফিরে যেতে চান। কিন্তু সম্রাট এ সিদ্ধান্তে নারাজ। কেননা রাজধানী প্যারিস ও ফ্রান্সের কিছু অঞ্চল তখনো ইংরেজের ছিল দখলে। সম্রাট সেসব উদ্ধার করতে জোয়ানের সহায়তায় চাইলেন। নিরুপায় জোয়ান আবার যুদ্ধে গেলেন। কিন্তু এবার ইংরেজ ও বার্গানডির ডিউকের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পরাজিত হলেন চার্লস। এ ঘটনার পরে সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল ফ্রান্সের মানুষ। এ পরাজয়ের জন্য তারা জোয়ানকেই দায়ী করলেন। যুদ্ধে তবু শেষ চেষ্টা করেছিলেন জোয়ান। কিন্তু তিনি ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে যান এবং বন্দী হন বার্গানডির ডিউকের সেনাপতি লুক্সেম্বার্গের হাতে। তারা তাকে জেলে পুড়ে দিল। বেশ কয়েকবার জোয়ান চেষ্টা করলেন জেল থেকে পালাবার, কিন্তু পারলেন না। এজন্য তাকে রাখা হলো টাওয়ারে। তিনি ষাট ফুট উঁচু টাওয়ার থেকে লাফ দিলেন। সেই দুর্গের চারদিকে জলপূর্ণ পরিখা ছিল। তিনি সেখানে পড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। গুরুতর আহত না হলেও চলতে পারার মতো সুস্থ তিনি ছিলেন না যখন জ্ঞান ফিরল। তাকে ইংরেজদের কাছে ১০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার তাকে বার্গুন্ডিয়ান ডিউক ফিলিপের কাছ থেকে কিনে নেয়। এক ইংরেজ ধর্মজীবী পাদ্রির অধীনে ১৪৩১ সালের ৯ই জানুয়ারী তার বিচার কার্যক্রম আরম্ভ হয়। 


প্রহসনের এ বিচারে তাকে কোন আইনজীবী দেয়া হয়নি। বিচারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে ‘তার উপর ঈশ্বরের বিশেষ দয়া আছে’ তিনি এমন বিশ্বাস পোষণ করেন কিনা। জবাবে জোয়ান বলেছিলেন “যদি আমি তা বিশ্বাস না করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে যেখানে আছি সেখানেই রেখে দেন, আর যদি বিশ্বাস করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে রক্ষা করেন।” আসলে এই প্রশ্নটিই ছিল সাংঘাতিক চালাকিপূর্ণ। যদি জোয়ান বলতেন ‘হ্যাঁ করি’, তবে তাকে ধর্মের বিরুদ্ধে যাবার অভিযোগ আনতেন আর যদি জোয়ান বলতেন ‘না’ তবে বলা হতো তিনি নিজের অভিযোগ নিজেই স্বীকার করেছেন। ছলচাতুরি বিচারে আদালত তাকে ১২ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী দোষি সাব্যস্ত করে। বিচারে তার কার্যকলাপকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাকে ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করা হয়। তার কোন আইনজীবি না থাকাতে জোয়ানকে রায় বিস্তারিত পড়ে শোনানো হয়নি। জোয়ান তখন বুঝতেও পারেনি, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তাকে কারাগারের একটি পিলারের সাথে বেঁধে ফেলা হয়। তাকে ডাইনি আর ধর্মহীনতার দায়ে ফাঁসিয়ে দেয়া হলো। চার্চের প্রতি অবাধ্যতার জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। তবে ইংরেজরা জোয়ানকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রকাশ্য রাস্তায় একটা মঞ্চের ওপর বাঁধা হলো তাকে। শেষবারের মতো করতে দেওয়া হলো প্রার্থনা । এরপর তার গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। লেলিহান শিখায় আবৃত হয়ে গেলেন সাহসিনী জোয়ান অব আর্ক। মাত্র ঊনিশ বছরের একটা মেয়েকে পুড়িয়ে মারল বাবার বয়সী মানুষেরা। 


এ ঘটনায় সপ্তম চার্লসের ভূমিকাটা কি ছিল ?


দুর্ভাগ্যক্রমে জোয়ান জীবন বাজি রেখে যে রাজাকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন সেই রাজা চার্লস একটিবারের জন্যও তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেননি। জোয়ানের নৃশংস মৃত্যুর পরেও সিংহাসনে বসতে একবারও বুক কাঁপেনি তার। তবে অনুতাপ আগুনে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছিলেন  সপ্তম চার্লসের অন্তর। সে কারণে তারই উদ্যোগে ঘটনার ১৪ বছর পরে জোয়ানের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ পুনর্বিচারের আদেশ দেন। প্রতিটি কাগজপত্র, জবানবন্দী খুঁটিয়ে দেখে করা হয় বিচার। সেই বিচারে জোয়ানের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণিত হয়। এখনো পৃথিবীর ইতিহাসে জোয়ান অব আর্ক এক প্রেরণার নাম। ফ্রান্সের প্যারিসে জোয়ানের একটি স্ট্যাচু রাখা হয়েছে।


সবশেষে বলা যায় আগুনে পোড়ালেই ইতিহাস শেষ হয় না। মাত্র ১৯ বছরের জোয়ান সেই কথাই করেছে প্রমাণ। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.