ডেভিড অ্যাটেনবোরোর মহাজাগতিক জীবন

 


ODD বাংলা ডেস্ক: পৃথিবীর কোন জীব এই গ্রহের সবচেয়ে বেশি দেখেছে? ভাবছেন নিশ্চয়ই অতল জলের নীল তিমি, কিংবা অক্লান্ত ডানায় ভর দিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার পরিভ্রমণ করা পরিযায়ী পাখি, গহন বৃষ্টি অরণ্যের কোন জন্তু, অতলান্তিক মহাসাগরের অজানা মাছ বা নদীর সরীসৃপ। কিন্তু এই মহান গর্বের, আমাদের নীল গ্রহটাকে সবচেয়ে ভাল করে দেখবার, ভ্রমণ করবার, উপভোগ করবার তকমা যার গায়ে তিনি আমার-আপনার মতই মানুষজাতির সদস্য, ডেভিড অ্যাটেনবোরো!


বলা হয়ে থাকে এই বিশাল গ্রহের হাতে গোনা দুয়েকটি জায়গা ব্যতিরেকে সবখানেই তার নিরলস পদচারণা, সেই সাথে প্রকৃতি সম্ভোগে তিনি একা নন, তার সেই অপরিমেয় অভিজ্ঞতার পাথেয় তিনি তুলে এনেছেন ভিডিও ক্যামেরায়, আলোকচিত্রে, লেখনীতে। ভাগ করেছেন সেই এক ও অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার কোটি কোটি মানুষের কাছে। পরিবেশ সচেতন করে তুলেছেন গোটা মানবজাতিকে। এই মহামানবের বিবিসিতে কর্মজীবনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রচারিত হয় তার একক জীবন নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র 'লাইফ অব এয়ার'।


ডেভিড অ্যাটেনবোরোর ইংল্যান্ডের বাড়িতে হাজির হন আরেক প্রখ্যাত পর্যটক ও মিডিয়ার অন্যতম পরিচিত মুখ মাইকেল পালিন। বাড়ি তো নয়, যেন সমৃদ্ধ এক জাদুঘর! লাখ লাখ বই, নানা দেশের মুখোশ, চিত্রকর্ম, জীবজগতের দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন- কী নেই সেখানে! প্রথমেই একের পর এক অদ্ভুত জিনিস দেখিয়ে সেই সম্পর্কিত প্রশ্ন করে জ্ঞানের ধাঁধাঁয় মেতে উঠেন চিরতরুণ, চির উৎসুক ডেভিড। সেই সংগ্রহে জীবাশ্মে পরিণত হওয়া ডাইনোসরের ডিম থেকে শুরু করে লাভার তৈরি আয়না, এমন জাত-বেজাতের জিনিসের সমাহার।


তথ্যচিত্রটির ফাঁকে ফাঁকে আসছে তার নানা সহকর্মী, পরিবেশবিদ, বন্ধুদের সাক্ষাৎকার।


তাদের একজন বলেন, ৫০ বছর আগে বিশ্বের ক'জন মানুষ জানত চির সবুজ বৃষ্টিঅরণ্যের রহস্য, ক'জন মানুষ আসলেই জানত সাগর তলের প্রবাল প্রাচীর নিয়ে!এই মানুষটির কাছে গোটা মানবজাতি অপরিসীম ঋণে আবধ্য।


পর্দায় হাজির হন ডেভিডের বড় ভাই বিশ্বখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা রিচার্ড অ্যাটেনবোরো (এখন প্রয়াত), উপমহাদেশের মানুষের কাছে যিনি বিশেষভাবে পরিচিত 'গান্ধী' চলচ্চিত্রটি পরিচালনার জন্য। বললেন তার ছোট ভাইটি শিশুকাল থেকেই বিশেষ উৎসাহী ছিল প্রকৃতি নিয়ে, তিল তিল করে সেই শৈশবেই গড়ে তুলে ছিলেন জীবাশ্মের এক মূল্যবান সংগ্রহ।


এরপরে একে একে নানা বিরল ঘটনার ভিডিও ক্লিপ ভেসে আসে রূপোলি পর্দায়- সিয়েরা লিওনের আদিবাসীদের গীত-নৃত্য, দুর্গম পাপুয়া নিউ গিনিতে নরখাদকের মুখোমুখি, কমোডো ড্রাগনকে ফাঁদে ফেলা- এমন টুকরো টুকরো রঙ ঝলমল স্মৃতি। ক্যামব্রিজ থেকে পড়ালেখা করা ডেভিড চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন বিবিসি রেডিওতে, চাকরি মিলল না বটে কিন্তু বিবিসি থেকে জানালো হল তারা নতুন এক যন্ত্রের প্রসারের জন্য মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যেখানে তার কাজ করার সুযোগ আছে, সেই নতুন যন্ত্রের নাম টেলিভিশন!


সেই যে যাত্রা শুরু, চমৎকার সব উদ্ভাবনী ধারণা দিয়ে টেলিভিশনের খোলনলচে পাল্টে দিলেন তিনি একাই, বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সরাসরি খেলার সম্প্রচার সব বিষয়েই তার কাছে ঋণী টেলিভিশন। এই সময় খোলা হল বিবিসির দ্বিতীয় শাখা বিবিসি-২, সেখানকার মহাপরিচালক হবার প্রস্তাব দেওয়া হল ডেভিডকে।


সেই সময়ের কথা মৃদু হেসে স্মরণ করলেন রিচার্ড, বললেন ডেভিড ছিল বেশ খানিকটা উত্তেজিত আর সেই সাথে বলেছিলেন সারাদিন চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয় বরং তার আনন্দ প্রকৃতিতে বিচরণ করে তথ্যচিত্র তৈরিতে। বিজ্ঞ বড় ভাইয়ের মত রিচার্ড বললেন, যেখানে খাঁটি আনন্দ পান সেই কাজটাই করতে!


ভাগ্যিস ডেভিড মনোলোভা মহাপরিচালকের পদ ফিরিয়ে দিয়ে শুরু করলেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ, প্রচারিত হল বিশ্বের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র 'সিভিলাইজেশন- অ্যাসেন্ট অব ম্যান', এক ঘণ্টার এই তথ্যচিত্র প্রচারের পরপরই মিডিয়া জগতে ঘটল প্রবল বিস্ফোরণ, পর্যায়ক্রমে সর্বজননন্দিত লাইফ সিরিজের প্রথম ধারাবাহিক প্রাথম প্রামাণ্যচিত্র 'লাইফ অন আর্থ'।


বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল এক নিবেদিতপ্রাণ অতিমানবের কাজ ও ধারণাকে- এক মুহূর্তে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বেলাভূমিতে, তো পরমুহূর্তেই আমাদের নিয়ে যান পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার সাগর তীরে। তার প্রথম তিন ধারাবাহিক 'লাইফ অব আর্থ', 'লিভিং প্লানেট', ট্রায়ালস অব পোল' পেল আশাতিরিক্ত জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান। এই সিরিজগুলোতে ডেভিড সারা বিশ্ব চষে আমাদের গ্রহে জীবনের উদ্ভব ও কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে বর্তমান জীবজগতের উন্মেষকে হাতে-কলমে প্রমাণ করলেন উপাত্তের সাহায্যে সরল বক্তব্যের মাধ্যমে।


দর্শকেরা শিউরে ওঠেন মাংসাশী শিম্পাঞ্জীর হিংস্রতা আর কিলার হোয়েলের শিকার নিয়ে খেলা দেখে, কিন্তু ডেভিড তাঁর নীতিতে অটল, তার মতে প্রকৃতি যেমন তাকে ঠিক তেমনভাবেই দেখানো উচিত। তবে বিনয়ের অবতার এই ভদ্রলোক বরাবরই তাঁর প্রোগ্রামের সব সাফল্য দিয়ে এসেছেন তার ক্যামেরা ক্রুদের। 


অন্যদিকে তারাও ডেভিডের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, দলের মধ্যে তিনিই সবার আগে সাতসকালে প্রস্তুত থাকেন, সবচেয়ে ভারি ব্যাগটা এই বয়সেও বহন করেন সবার অনুরোধ অগ্রাহ্য করে, সেই সাথে মুখিয়ে থাকেন সবসময় অন্যদের সাহায্য করতে।


একের পর এক স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল খুঁড়ে ডেভিড অ্যাটেনবোরো আমাদের জন্য নিয়ে আসেন অজানা অতি প্রয়োজনীয় জ্ঞান ভাণ্ডার। বরফাবৃত মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকার জীব বৈচিত্র নিয়ে নির্মাণ করেন 'লাইফ ইন দ্য ফ্রিজার', উদ্ভিদ জগৎ নিয়ে 'লাইফ অব প্ল্যান্টস', পাখিদের নিয়ে 'লাইফ অব বার্ডস', স্তন্যপায়ীদের নিয়ে 'লাইফ অব ম্যামালস', অতি ক্ষুদে অমেরুদণ্ডী পোকামাকড়ের ঘর-বসতি নিয়ে 'লাইফ আন্ডারগ্রোথ', সরীসৃপদের নিয়ে 'লাইফ ইন কোল্ড ব্লাড', আর পৃথিবীর প্রথমদিকের আদি জীবদের নিয়ে 'ফার্স্ট লাইফ'। এর অধিকাংশ ধারাবাহিকেই আছে দশটির মত পর্ব। নিখুঁত নতুন ভিডিও ক্লিপে ঠাসা আর সেই সাথে ডেভিডের উদ্বাত্ত কণ্ঠের জাদুকরী বর্ণনা।


বিশেষ করে গাছের জীবন নিয়ে তার বিবিসিতে ধারাবাহিক তথ্যচিত্র সম্প্রচারের প্রস্তাবে সবাই বেঁকে বসেছিল। কারণ নড়ে চড়ে না এমন কিছু নিয়ে ডেভিডের সাথে তথ্যচিত্র নির্মাণ করা, এতো প্রায় অসম্ভব, কারণ সে তো চায় সবসময়ই সবচেয়ে ভাল কাজ। অনেক বাধার পরে 'লাইফ অব প্ল্যান্টস' প্রচারিত হবার পর কোটি কোটি মানুষের চিন্তা ভাবনা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায় উদ্ভিদ জগৎ নিয়ে, আমাদের সামনে আসে সত্যিকারের আলোকময় বিশুদ্ধ জ্ঞান।


উপরে উল্লেখিত সবগুলো ধারাবাহিকে ডেভিড স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন ক্যামেরার সামনে, কিন্তু দৃশ্যপটের বাইরে থেকেও সঠিক দিকনির্দেশনা ও জাদুকরী ধারাভাষ্য দিয়েও নির্মাণ করেছেন একাধিক বিশ্বসেরা ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্র। বিশেষ করে অথৈ নীল সাগর নিয়ে তার তৈরি 'ব্লু প্লানেট', আমাদের গ্রহের সব ধরনের প্রাকৃতিক স্থান নিয়ে 'প্লানেট আর্থ', পরিযায়ী প্রাণীদের নিয়ে 'ন্যাচারস গ্রেট ইভেন্টস', সারা বিশ্বের সব অঞ্চলের বুনো প্রাণীদের নিয়ে 'ওয়াইল্ড লাইফ' সিরিজ।


তার নিউ গিনি, ইস্টার দ্বীপ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে 'অ্যাটেনবোরো ইন প্যারাডাইস'- সবগুলোই জয় করেছে,  আন্দোলিত করেছে দর্শকচিত্ত, চিনিয়েছে আমাদের গ্রহকে নতুনভাবে।


উপস্থাপক মজলিসী আমেজে খোঁজার চেষ্টা করেছেন কী করে এই ৯৭ বছর বয়সেও ডেভিড চির সবুজ, এখনো তিনি সমান উৎসুক জ্ঞানের সন্ধানে, কিসের নেশায় ব্যগ্র হয়ে চষে ফেরেন দুই গোলার্ধ। এর ফাঁকে দেখা যায় চিত্রগ্রহণের সময় ঘটে যাওয়া কিছু মজাদার ঘটনা- হাতি সীলের তাড়া খাওয়া ডেভিড, আগ্নেয়গিরির ধোঁয়ায় ঢেকে পড়া, গুহার গহীনে বাদুড়ের বিষ্ঠার উপরে বিবমিষায় আক্রান্ত, পাখির আক্রমণে ভূলুণ্ঠিত।


পরবর্তী কয়েক মিনিটে দেখানো হয় ডেভিডের বর্ণনা ও অংশগ্রহণে ভূগোল ও জীবজগতের বিস্ময়গুলো- বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাণী নীল তিমি, সবচেয়ে ভারী জীবিত অরগ্যান দৈত্যাকার সাইকামোর গাছ, বোর্ণিও দ্বীপের এক গাছের সবচেয়ে বড় পাতা, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল, অন্যতম বৃষ্টিবহুল স্থান ভেনিজুয়েলার মাউন্ট রোরাইমা, সবচেয়ে গভীর উপত্যকা নেপালের কালীগণ্ডকী, শীতলতম স্থান অ্যান্টার্কটিকা, উচ্চতম পর্বতমালা হিমালয়- এমনিভাবে সারা পৃথিবীর আশ্চর্যের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে মাত্র কয়েক মিনিটের মাঝেই।


সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে আমাদের গ্রহের সবচেয়ে বেশি স্থান ও ঘটনা অবলোকনকারী মানুষটি জানান, বিশ্বকে তিনি এমনভাবেই দেখাতে চান যেমনভাবে এটি আছে, তবে সর্বশক্তিমান কোন প্রভু বা শক্তির কথা তার কল্পনাতেও আসে না।


প্রিয় পাঠক, এই তথ্যচিত্রটি প্রচারিত হয়েছিল ২০০২ সালে, আজ থেকে দুই দশক আগে, ডেভিড অ্যাটেনবোরোর মহাজাগতিক অক্লান্ত যাত্রা কিন্তু চলছে অবিরাম গতিতে। ১৯২৬ সালের ৮ মে যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণকারী ডেভিড অ্যাটেনবোরোর বয়স এখন ৯৭ বছর। এই চিরউৎসুক, জ্ঞানপিপাসু, সবুজ মনের চির তরুণ কয়েক বছর আগেও মাদাগাস্কারের বিলুপ্ত দানব পাখির ডিম নিয়ে নির্মাণ করেছেন নতুন তথ্যচিত্র, যার কারণে এই দ্বীপে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন দীর্ঘ ৫০ বছর পরে! এরপরেও অব্যাহত আছে বিশ্ববাসীর কাছে পাঠানো তার অমূল্য উপহার।‌ সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে যুক্তরাজ্যের জীবজগতে নিয়ে নতুন প্রামাণ্যচিত্র।


ডেভিডের কাছের বন্ধু বিশ্বখ্যাত জীবতত্ত্ববিদ ডেসমণ্ড মরিস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ষাট বছর বয়সে ডেভিড আমাকে বলেছিল যে আশি বছর বয়সে সে সরীসৃপদের নিয়ে একটি ধারাবাহিক তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে চায়, যার নাম হবে 'লাইফ ইন কোল্ড ব্লাড'।নসেটা এখন করতে না পারার কারণ আগামী কুড়ি বছর তার নানা পরিকল্পনায় ঠাসা!


অবশেষে সত্যিই ৮০ বছর বয়সে ডেভিড অ্যাটেনবোরো 'লাইফ ইন কোল্ড ব্লাড' প্রচার করেন, বিশ্বকে দেন আরেক অমুল্য উপহার। সেই সাথে সাথে প্রকাশ করে চলেছেন একের পর এক মনোমুগ্ধকর ছবি আর প্রাঞ্জল ভাষায় পৃথিবীর সেরা বইগুলো।


পুরষ্কার আর উপাধির শতধা বিশেষণে স্নাত তিনি, নাইটহুড থেকে শুরু করে এনভায়রনমেন্টাল হিরো সবকিছুই, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হলো শতকোটি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।


অন্তত শতায়ু হোন আপনি ডেভিড অ্যাটেনবোরো, আপনাকে ভীষণ প্রয়োজন আমাদের, মানব জাতির, সমস্ত প্রাণী জগতের, এই নীল গ্রহটার। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.