ইতিহাসের কিংবদন্তিতুল্য দুর্ধর্ষ ৬ মার্সেনারি বাহিনী
ODD বাংলা ডেস্ক: সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্সেনারি বাহিনী 'ওয়াগনার গ্রুপ' নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বাহিনীর ঘটনা নতুন নয়। ইতিহাসে পাতায় বেশ কয়েকটি দুর্ধর্ষ কিংবদন্তিতুল্য সেনাদলের নাম জানা যায় যেগুলো ভাড়াটে যোদ্ধাদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল।
ঐতিহাসিকভাবে কুখ্যাত ও প্রভাবশালী সৈন্যদলগুলো নির্দিষ্ট কোনো শাসক কিংবা দেশের প্রতি অনুগত ছিল না। বরং এ বাহিনীগুলো ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে প্রয়োজন অনুযায়ী যুদ্ধ করতেন কিংবা রক্ষক হিসেবে কাজ করতেন।
১. দ্য টেন থাউজেন্ড
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জেনোফোনের বই 'আনাব্যাসিস' এ 'দ্য টেন থাউজেন্ড' নামের একটি র্সেনারি বাহিনীর কথা জানা যায়। প্রায় দশ হাজার গ্রীক যোদ্ধাদের নিয়ে বাহিনীটি গঠিত হয়েছিল। দলটি ক্ষমতা দখল করতে চাওয়া সাইরাস দ্য ইয়ংগার নামের এক ব্যক্তির সাথে চুক্তি করেছিল। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল তার ভাই রাজা দ্বিতীয় আর্টক্সারক্সেসকে পারস্যের সিংহাসন থেকে উৎখাত করা।
'দ্য টেন থাউজেন্ড' বাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ভাড়াটে বাহিনীটি ৪০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাসের বিদ্রোহী সেনাদলের সাথে যুক্ত হয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। বাগদাদের কাছে হওয়া এ যুদ্ধে বাহিনীটি তৎকালীন পারস্যের রাজার বিপক্ষে লড়াই করেছে।
রাজা দ্বিতীয় আর্টক্সারক্সেসের সেনাদলের সাথে ভাড়াটে 'টেন থাউজেন্ড' বাহিনী বেশ ভালোই যুদ্ধ করছিল। তবে বিপত্তি ঘটে যখন যুদ্ধের এক পর্যায়ে সাইরাস নিহত হয়। এমতবস্থায় ভাড়াটে সেনাদলটির জেনারেল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিপক্ষের সাথে আলাপ করতে যান। কিন্তু তখন বাহিনীটির জেনারেল বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়ে খুন হন।
সাইরাস ও জেনারেলের মৃত্যুর পর আর্টক্সারক্সেসের সৈন্যদল ও স্থানীয়দের কবল থেকে টেন থাউজেন্ড বাহিনীকে বেঁচে ফিরতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এমতবস্থায় তারা জেনোফোন নামের একজন বিচক্ষণ মিলিটারি কৌশলীকে নিজেদের নতুন নেতা ঘোষণা করে। এরপর শত বাঁধার মধ্যেও সেনাদলটি দীর্ঘ নয় মাসের যাত্রায় ব্যাবিলোনিয়া থেকে ট্র্যাপিজাসে অবস্থিত গ্রীক ব্ল্যাক সি বন্দরে পৌঁছাতে সমর্থ হয়।
এই ঘটনায় একের পর এক অতর্কিত আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে, প্রতিকূল আবহাওয়া ও দুর্ভিক্ষের মাঝেও বাহিনীটির মোট সদস্য সংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জীবিত ছিল এবং নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে পেরেছিল।
জেনোফোনের নেতৃত্বে 'দ্য টেন থাউজেন্ড' সেনাদলের বীরত্ব সেই থেকে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি ১৯৭৯ সালে ঐতিহাসিক এ ঘটনা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিখ্যাত সিনেমা 'দ্য ওয়ারিয়র্স'।
২. দ্য হোয়াইট কোম্পানি
ইতিহাসে 'দ্য হোয়াইট কোম্পানী' কুখ্যাত মার্সেনারি বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাহিনীটি ১৪ শতকে ইতালির বেশিরভাগ যুদ্ধের সাথে যুক্ত ছিল। ১৩৬০-এর দশকে বাহিনীটি সর্বপ্রথম পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে স্যার জন হকউড নামের এক ইংরেজ বাহিনীটির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি 'দ্য হানড্রেড ইয়ারস' যুদ্ধে নাইট উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
হকউডের নেতৃত্বে তৎকালীন সময়ে 'দ্য হোয়াইট কোম্পানি' ইতালির সবচেয়ে অভিজাত মার্সেনারি বাহিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর সৈন্যদের মধ্যে ছিল ইংরেজ, জার্মান, হাঙ্গেরিয়ান ইত্যাদি। দুঃসাহসিক মানসিকতা ও ভিন্নধর্মী সব দক্ষতার জন্য বাহিনীটি বিখ্যাত ছিল। এটি আচমকা দ্রুতবেগে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতো। এমনকি প্রতিকূল আবহাওয়া কিংবা রাতের বেলাতেও যুদ্ধ করে বাহিনীটি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতো।
১৪ শতকে ইতালি যুদ্ধরত নগর-রাষ্ট্র এবং মধ্যযুগীয় শাসকদের মধ্যে বিভক্ত ছিল। সেই সময় 'দ্য হোয়াইট কোম্পানির রীতিমতো নিলাম করে সর্বোচ্চ অর্থদাতার পক্ষে কাজ করতো।
১৩৬৩ থেকে ১৩৮৮ সাল পর্যন্ত বাহিনীটি মিলান ও ফ্লোরেঞ্জ শহরের পক্ষে-বিপক্ষে লড়াই করেছে। এমনকি যেই সময়টাতে ইতালিতে শান্তি বজায় ছিল, তখনও গ্রাম ও শহরে হামলা করে তারা লুটপাট করতো।
৩. দ্য সুইস গার্ড
বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটিতে পোপের সাথে ডোরাকাটা-ইউনিফর্মধারী রক্ষক হিসেবে যাদের দেখা যায়, তারাই একসময়ের 'দ্য সুইস গার্ড'। রেনেসাঁর সময়টাতে তারা ছিল কুখ্যাত মার্সেনারি বাহিনী।
প্রথম ইউরোপীয় বাহিনী হিসেবে তারা শক্তিশালী সাঁজোয়া শত্রুদের বিরুদ্ধে পাইক এবং হ্যালবোর্ড ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করেছিল। ১৪০০ এর দশকের মধ্যে বাহিনীটির বিপ্লবী কৌশল এবং নির্মমতা মার্সেনারি গ্রুপ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। এমনকি ফ্রেঞ্চ রেভুলেশনেও এই সুইস ভাড়াটে দল ফ্রেঞ্চদের পক্ষে যুদ্ধ করেছে এবং অনেকেই এতে নিহত হয়েছেন।
১৫০৬ সালে সুইস গার্ডের ১৫০ জনের একটি ছোট দল পোপের দেহরক্ষী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে সুইজারল্যান্ডের নাগরিকদের ভাড়াটে সৈন্য হওয়া নিষিদ্ধের পরেও ইউনিটটি ভ্যাটিকানের অফিসিয়াল প্রহরী হিসাবে কাজ করেছে।
বর্তমানেও রয়েছে উজ্জ্বল রঙের রেনেসাঁ যুগের ইউনিফর্ম পরিহিত সুইস গার্ড। এতে যোগদানের যোগ্যতা হিসেবে রোমান ক্যাথলিক হতে হবে, কমপক্ষে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে এবং একটি সামরিক অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
যদিও বর্তমানে সুইস গার্ডের কাজগুলো অনেকটা আনুষ্ঠানিক। তবে অতীতে পোপকে রক্ষা করতে গার্ডটি লড়াই করেছে। ১৫২৭ সালে রোমে এক আক্রমণের সময় পোপ ক্লিমেন্ট সপ্তমকে আটকের হাত থেকে রক্ষা করে তারা। এতে পোপের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রায় ৮০ ভাগ সুইস গার্ড নিহত হয়েছিল।
৪. দ্য ফ্লাইং টাইগার্স
আমেরিকান ভলান্টিয়ার গ্রুপ নামে পরিচিত 'দ্য ফ্লাইং টাইগার্স' ছিল ফাইটার পাইলটদের একটি মার্সেনারি বাহিনী। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিজদের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিল।
১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে হামলার ঠিক আগ মুহূর্তে ইউনিটটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বাহিনীটি তৈরি করতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রাক্তন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা ক্লেয়ার চেন্নাল্টকে বিমান বাহিনী থেকে গোপনে ফাইটার জক নিয়োগের অনুমতি দেন।
একজন ফাইটারের জন্য এটি ছিল বেশ ঝুঁকির কাজ। কিন্তু ঝুঁকির সাথে সাথে এতে বেতনও বেশি ছিল। সাধারণভাবে বিমানবাহিনীর একজন পাইলট মাসে প্রায় ২৬০ মার্কিন ডলার বেতন পেতেন। সেখানে চেন্নাল্টের ভাড়া করা পাইলটেরা ৬০০ ডলার থেকে ৭৫০ ডলারের মতো বেতন পেতেন। সাথে একটি জাপানি বিমান ধ্বংস করতে পারলে আরও ৫০০ ডলার বোনাস হিসেবে পেতেন।
১৯৪১ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় একশ জন আমেরিকান চুক্তিভিত্তিক পাইলট বার্মায় এসেছিলেন। যাদের মূল দায়িত্ব ছিল জাপানের আক্রমণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই সড়ক রক্ষা করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে 'ফ্লাইং টাইগার্স' অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে৷ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই আমেরিকানরা ২৯৬ টি জাপানি বিমান ভূপাতিত করে এবং ১৩০০ টিরও বেশি রিভারবোট ধ্বংস করতে সমর্থ হয়। বিপরীতে তারা মাত্র ৬৯ টি বিমান এবং প্রায় দুই ডজন লোক হারিয়েছিল।
১৯৪২ সালের জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে 'দ্য ফ্লাইং টাইগার্স' ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এর কিছু সংখ্যক সদস্য পরে তাদের পুরানো ইউনিটে যোগদান করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কাজ করে।
৫. দ্য কাতালান গ্র্যান্ড কোম্পানি
১৩০২ সালে অভিযাত্রী রজার ডি ফ্লোর 'কাতালান গ্র্যান্ড কোম্পানি' নামে মার্সেনারি বাহিনীটি প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত প্রথমদিকে ইতালিতে সিসিলিয়ান ভেসপারের যুদ্ধের অভিজ্ঞ স্প্যানিশ সৈনিকদের নিয়ে এটি গঠন করা হয়। এক পর্যায়ে ডি ফ্লোর এবং তার ভাড়াটে সৈন্যরা নিজেদেরকে বাইজেন্টাইন সম্রাট দ্বিতীয় আন্দ্রোনিকাস এর সাথে চুক্তিবদ্ধ করে। এ সম্রাট অটোমান তুর্কিদের আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সেনাদলটিকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিয়ে আসেন।
৬৫০০ সৈন্যের শক্তিশালী কাতালান কোম্পানি তুর্কিদের কনস্টান্টিনোপল থেকে দূরে সরিয়ে দিতে সফল হয়েছিল। কিন্তু তাদের লুটপাটের প্রবণতা বাইজেন্টাইনরা বেশ নেতিবাচকভাবে নিয়েছিল।
১৩০৫ সালে ডি ফ্লোর এবং তার প্রায় ১৩০০ জন সৈন্য ভাড়াটেদের অন্য একটি গ্রুপ দ্বারা অতর্কিত আক্রমণের স্বীকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
বেঁচে থাকা সৈন্যরা দলটি ভেঙে ফেলার পরিবর্তে মধ্যযুগীয় সামরিক ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী এবং বিস্ময়কর দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করে। প্রথমে তারা গ্যালিপোলিতে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। পরে তাতে ব্যর্থ হয়ে ডিউক অফ এথেন্সের পক্ষে কাজ করতে থাকে।
কিন্তু বেতন নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে কাতালানরা ডিউক অফ এথেন্সের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নামে। বাহিনীটি ১৩১১ সালে কেফিসোসের যুদ্ধে গ্রীক সৈন্যদের পরাজিত করে এবং ডিউককে হত্যা করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে এথেন্সের ডি ফ্যাক্টো লর্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।
আশ্চর্যজনকভাবে, 'কাতালান গ্র্যান্ড কোম্পানি' নামের মার্সেনারি বাহিনীটি ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্রিসের বিশাল অংশে শাসন করতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর ফ্লোরেন্সের একটি বাহিনীর সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের পতন হয়।
৬. দ্য ভারাঙ্গিয়ান গার্ড
'দ্য ভারাঙ্গিয়ান গার্ড' ছিল নর্সেম্যানদের বংশধর যারা মূলত জলদস্যু এবং ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করতেন। এরা ছিল মূলত একটি মার্সেনারি ভাইকিং দল যারা বাইজেন্টাইন সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসাবে কাজ করার সুযোগ পের্যেছিলেন। ১০ শতকের শেষের দিকে সম্রাট দ্বিতীয় বেসিলের দায়িত্বে থাকা গার্ডটি একটি বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। পরবর্তীতে দুইশত বছরেরও বেশি সময় ধরে বাহিনীটি কনস্টান্টিনোপলের রক্ষক হিসাবে কাজ করেছিল।
প্রথমদিকে, ভারাঙ্গিয়ান গার্ড মারাত্মক লড়াইয়ের মানসিকতাসম্পন্ন ভাইকিংদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু ১১ শতকের শেষের দিকে বাহিনীটিতে ইংরেজ, নরম্যান এবং ডেনিসরাও যুক্ত হতে থাকে। তবে দলটিতে যোগদান সহজ ছিল না। এক্ষেত্রে যুদ্ধে সৈন্যদের সক্ষমতার পরিচয় দিতে হতো।
ভারাঙ্গিয়ান গার্ডদের মধ্যে অনেকেই ছিল বেশ ধনী। কেউ কেউ আবার বহু ক্ষমতাসীন পদেও অসীন হয়েছিলেন। এমনি একজন বাহিনীটির বিখ্যাত রক্ষীদের একজন হ্যারাল্ড হার্দ্রদা। তিনি পরবর্তীতে নরওয়ের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
Post a Comment