বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মার্সেনারি বাহিনী কারা?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংকটময় পরিস্থিতিতে ও নিরাপত্তা রক্ষার খাতিরে বেসরকারি সামরিক সংস্থাগুলোর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের প্রাইভেট মিলিটারি কনট্রাক্টর বা প্রাইভেট সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টর বলে অভিহিত করে। 


বেসরকারি সামরিক সংস্থাকে 'মার্সেনারি সংস্থা'ও বলা হয়ে থাকে। যদিও মার্সেনারিরা চাইলে এককভাবে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করতে পারে, আবার কোনো সংস্থার অধীনেও কাজ করতে পারে। আধুনিককালে বিশ্বের বিভিন্ন সঙ্ঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সরকার তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে চায় না। এসব অঞ্চলে সরকারের হয়ে লড়াই করে যাচ্ছে মার্সেনারিরা।


সম্প্রতি ইরাকে মার্কিন বাহিনীর বদলে ৫ হাজার সশস্ত্র কন্ট্রাক্টরের একটি দল নিয়োজিত করা হয়েছে। এছাড়াও এ অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার রাখার জন্যও আরও অনেক মার্সেনারি নিয়োগ করা হয়েছে। 


কখনো কখনো মার্সেনারিদের এমন সব জায়গায় পাঠানো হয় যা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন অনেকে।


সিকিউরিটি জায়ান্ট জিফোরএস 


বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি নিয়োগদাতা সিকিউরিটি জায়ান্ট জিফোরএস-এর বর্তমান কর্মীসংখ্যা ৬ লাখ ২৫ হাজার। লন্ডনভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটির কাজের একটি অংশ হলো ব্যাংক, কারাগার ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা। একইসঙ্গে জিফোরএস বিশ্বজুড়ে সংকটপূর্ণ অঞ্চলগুলোতেও কাজ করে।


২০০৮ সালে জিফোরএস আর্মারগ্রুপ অধিগ্রহণ করে। উল্লেখ্য, আর্মারগ্রুপের ৯ হাজার গার্ড ইরাকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নন-মিলিটারি সাপ্লাই কনভয়কে সুরক্ষা দিয়েছে।


কিন্তু সমন্বিতভাবে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের ১২৫টিরও বেশি দেশে নিরাপত্তাবিষয়ক কাজে যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অত্যন্ত বিপজ্জনক কিছু এলাকাও রয়েছে, যেখানে জিফোরএস সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী, ল্যান্ড-মাইন ক্লিয়ারেন্স, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে থাকে।


ইউনিটি রিসোর্সেস গ্রুপ


ইউনিটি রিসোর্সেস গ্রুপ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, আমেরিকা ও এশিয়ায় সক্রিয়। অস্ট্রেলিয়ান মালিকানাধীন ইউনিটি রিসোর্সেস গ্রুপের ১২০০-র বেশি কর্মচারী বিশ্বের বিভিন্ন নানা কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানটি ইরাকে তাদের অবস্থান বেশ জোরালোভাবেই জানান দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আছেন এই প্রতিষ্ঠাননের ব্যবস্থাপনায়।


বাগদাদে অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ইউনিটি রিসোর্সেস গ্রুপ সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পায়। তারা চিলিয়ান যোদ্ধাদের মেশিনগান নেস্ট ও ফটক সুরক্ষিত রাখার প্রশিক্ষণও দিয়েছে।


ইউনিটির কর্মীরা দুটি বিতর্কিত গোলাগুলির ঘটনার জন্যেও দায়ী। গাড়িতে গোলাগুলির এই দুটি ঘটনায় একজন অস্ট্রেলিয়ান অধ্যাপক এবং দুজন বেসামরিক নারী নিহত হয়েছিলেন।


ইরাকের বাইরে ইউনিটি গ্রুপ লেবাননের সংসদ নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল এবং তারা বাহরাইনের ক্রাইসিস জোন থেকে বেসরকারি তেলের কোম্পানিগুলো সরিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।


এরিনিস ইন্টারন্যাশনাল 


কোয়ালিশন প্রভিশনাল অথরিটির দেওয়া চুক্তি অনুযায়ী এরিনিস ইন্টারন্যাশনাল ইরাকের তেল মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করতে একটি 'অয়েল প্রোটেকশন ফোর্স' গঠন ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সবচেয়ে বড় মিশন হলো, ইরাকের ২৮২টি লোকেশনে ১৬ হাজার প্রহরী নিয়োজিত করে দেশটির প্রধান তেলের পাইপলাইনসমূহ এবং অন্যান্য জ্বালানির উৎসগুলো সুরক্ষিত রাখা। 


এর বাইরে আফ্রিকাতেও রয়েছে তাদের সরব উপস্থিতি। সম্প্রতি রিপাবলিক অব কঙ্গো তাদের প্রধান লৌহ আকরিক এবং তেল ও গ্যাস প্রকল্পের নিরাপত্তার জন্য দুটি চুক্তি দিয়েছে এরিনিসকে। 


এশিয়া সিকিউরিটি গ্রুপ


আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই শক্তিশালী আফগান বাহিনীর নাম। একসময় এর মালিকানা ছিল প্রেসিডেন্টের ফার্স্ট কাজিন হাশমত কারজাইয়ের হাতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটিতে এশিয়া সিকিউরিটি গ্রুপ অন্যতম প্রধান আঞ্চলিক বাহিনী। তাদের অধীনে প্রায় ৬০০ গার্ড কাজ করে।


এই বেসরকারি সামরিক সংস্থাটির সদর দপ্তর কাবুলে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের চুক্তি পেয়েছে এবং আফগানিস্তানের দক্ষিণে কোয়ালিশনের সাপ্লাই কনভয়কে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল এদের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন কনট্রাক্টর ডাইনকর্পও এশিয়া সিকিউরিটি গ্রুপের মার্সেনারিদের নিয়োগ দিয়েছে।


ইরাক থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট যে আটটি বেসরকারি সামরিক সংস্থাকে ইরাকে অবস্থানের জন্য বিশেষভাবে বাছাই করেছে, ভার্জিনিয়াভিত্তিক ডাইনকর্প তার একটি।


কিন্তু এই বিশাল সংস্থাটির কার্যক্রম ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকাতেও। সংস্থাটির কর্মীসংখ্যা ১০ হাজারের বেশি এবং বছরে প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে। ২০০০-এর দশকের শুরুতে কলম্বিয়াতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াই করেছে ডাইনকর্প মার্সেনারিরা। সহিংস মনোভাবের জন্য বিশেষ পরিচিতি রয়েছে তাদের। এছাড়া, পেরুতে মাদকবিরোধী মিশনেও তাদের বাহিনী যুক্ত ছিল এবং সোমালিয়া, লাইবেরিয়া ও দক্ষিণ সুদানে যোদ্ধাদের নিরস্ত্র করতে তাদের পাঠানো হয়েছিল।


ট্রিপল ক্যানোপি


ইরাকের কাছ থেকে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হস্তগত করেছে এই সংস্থা। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়োজিত ৮টি কন্ট্রাক্টরের মধ্যে একটি হলো ট্রিপল ক্যানোপি। ইরাকে তাদের ১৮০০ ট্রুপ রয়েছে—যাদের অধিকাংশই উগান্ডা ও পেরুর। 


ইরাকে তাদের বাহিনী সম্পর্কে রিভিউতে বলা হয়েছে, তারা সুপ্রশিক্ষিত এবং উল্লেখযোগ্য পূর্ব-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পেশাদার বাহিনী। তবে ইরাকের বাইরেও বিশ্বজুড়ে তাদের ৩ হাজার কর্মী নিযুক্ত রয়েছে।


অন্য চুক্তিগুলোর ফলে ট্রিপল ক্যানোপি হাইতিতে কাজ করেছে, সেখানে তারা মার্কিন দূতাবাস প্রহরা দিয়েছে। আবার ইসরায়েলে ক্যানোপির এজেন্টরা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে ব্যক্তিগতভাবে সুরক্ষা দিয়েছে।


ইজিস ডিফেন্স সার্ভিসেস


ইজিস ডিফেন্স সার্ভিসেস জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করে। তারা বেসরকারি ক্লায়েন্ট, জাতিসংঘের মিশন ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বিশেষ করে ইরাকে রক্ষী দেয়।


তবে আফগানিস্তান ও বাহরাইনেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মী প্রায় ৫ হাজার কর্মী রয়েছে। এসব অঞ্চলে তারা জরুরি সেবা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা করে থাকে।


২০০৫ সালে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওর মাধ্যমে সম্ভবত ইজিস সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পায়। বিতর্কিত সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, ইজিসের বাহিনী ইরাকের বেসামরিক নাগরিকদের গুলি করছে।


ডেফিওন ইন্টারনাসিওনালে


ডেফিওন ইন্টারনাসিওনালে থেকে উন্নত দেশগুলো যোদ্ধা নিয়োগ করে। অতীতে ট্রিপল ক্যানোপিও ডেফিওনের বিভিন্ন পদমর্যাদার যোদ্ধাদের এনে নিজেদের বাহিনীতে নিয়োগ দিয়েছে। 


ডেফিওন লাতিন আমেরিকা অঞ্চল থেকে বেসরকারি সামরিক কর্মী নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর পেরুতে। তবে দুবাই, ইরাক, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায়ও তাদের কার্যালয় রয়েছে।


ডেফিওন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উন্নয়নশীল দেশ থেকে দেহরক্ষী, চালক, স্ট্যাটিক গার্ড ও লজিস্টিকস বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে চুক্তি করে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। কখনো কখনো এসব এজেন্টদের মাসিক মাত্র ১ হাজার ডলার বেতনও দেওয়া হয়—যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে কাজটা যখন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে সংশ্লিষ্ট।


একটা সময় মধ্যপ্রাচ্যে ১ হাজারের বেশি 'গানস-ফর-হায়ার' বা অর্থের বিনিময়ে পেশাদার ভাড়াটে যোদ্ধা নিযুক্ত ছিল। যদিও এই যোদ্ধাদের কতজন আসলেই ডেফিওনের হয়ে কাজ করতেন তা স্পষ্ট নয়, কারণ ডেফিওন তাদের ভাড়াটে যোদ্ধার সংখ্যা প্রকাশ করতে বাধ্য নয়।


একাডেমি


বিশ্বের অন্যতম উন্নত বেসরকারি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা ও এর মালিকানা একাডেমি-র হাতে। প্রথমে ব্ল্যাকওয়াটার, তারপর জি সার্ভিসেস, অবশেষে একাডেমি নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি নর্থ ক্যারোলাইনার বনাঞ্চলের গভীরে ৭ হাজার একরের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে তাদের, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও জটিল সামরিক প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র।


২০০৭ সালে ব্ল্যাকওয়াটারকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধীনে ২০ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল সেনাবাহিনী, ২০টি এয়ারক্রাফট, সাঁজোয়া যানের বহর ও প্রশিক্ষিত কুকুর রয়েছে।


কিন্তু একাডেমির বেশকিছু ভুল গোলাগুলির ঘটনা ও বিতর্কিত কার্যক্রম ইরাক সরকারকে ক্ষুদ্ধ করে। এর ফলে তাদের কিছু চুক্তি বাতিল করা হয় এবং সংস্থাটি পিছিয়ে পড়ে।


মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে কাজের মধ্যে, হ্যারিকেন ক্যাটরিনার পর নিউ অরলিন্সের রাস্তাগুলো সুরক্ষার জন্য একাডেমি'কে নিয়োগ করা হয়েছিল। এছাড়াও, এটি জাপানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও সুরক্ষা দিয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করেছে।


এছাড়া একাডেমির ওয়েব স্টোর থেকে আধুনিক সব সরঞ্জামও কেনা যায়। প্রোটেক্টিভ সানগ্লাস থেকে শুরু করে ব্র্যান্ডেড গিফট পর্যন্ত সবকিছুই রয়েছে তাদের কাছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.