ইম্পোস্টার সিনড্রোম কী

 


ODD বাংলা ডেস্ক: আপনি কি নিজের সব অর্জনকে সন্দেহের চোখে দেখছেন? নিজেকে এর অযোগ্য বলে মনে করছেন? আপনার অর্জনের পেছনে পরিশ্রম, মেধাকে বড় করে না দেখে সর্বদা ভাগ্যেরই জয়গান গাইতে থাকেন? আর এই কারণেই নিজেকে একজন প্রতারক বা ছলনাকারী বলে মনে হয়? কিংবা আপনার কি সর্বদা মনে হয়—কেউ আপনার মুখোশটা খুলে দেবে, আপনার আসল পরিচয়টা সবার সামনে বের করে আনবে? যদি সর্বদা এই অনুভূতিগুলো আপনাকে ঘিরে রাখে, তাহলে আশঙ্কা রয়েছে আপনি ইম্পোস্টার সিনড্রোমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।


নানা কারণে পিছিয়ে পড়া নারীদের মধ্যে এই বিষয়টির প্রভাব দেখা দেয়। যেমন কৃষ্ণাঙ্গ, ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর নারী। তাদের সফল হওয়ার জন্য সাধারণ কোনো পুরুষের চেয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনুসরণ করার মতো সফল নারী তারা খুঁজে পান না। তখনই তাদের আত্মবিশ্বাসে টান পড়ে। করপোরেট দুনিয়ায় এটি বেশি হয়ে থাকে। কারণ সেখানে যখন কোনো নারী সফল হতে শুরু করেন, তখন তিনি তার সহযোদ্ধা হিসেবে নারীদের খুব কম পেয়ে থাকেন। তখনই এমন ধারণার তৈরি হয়, হয়তো তিনি দৈববলে সব পেয়ে যাচ্ছেন। তার মধ্যে এত সফলতা অর্জনের যোগ্যতা নেই।


নারীরা নিজেদের শারীরিক সৌন্দর্যের জন্য সব ক্ষেত্রেই প্রশংসনীয়। এ কারণে অনেক সময় তাদের সফলতার জন্য এমনটা শুনতে হয় যে, শুধু নারী বলে বা নিজের সৌন্দর্য দেখিয়ে সফল হচ্ছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে সমতা রক্ষার জন্য নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন নারীদেরকে কটুক্তি শুনতে হয় যে সিস্টেমের কারণে তারা এই অবস্থান পেয়েছে, তা যোগ্যতা দিয়ে নয়। যা তার ইমপোস্টার হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


এই সমস্যাটি বেশির ভাগ নারীকে ভোগ করতে হলেও এর থেকে নিরাময়ের তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট উপায় এখনো জানা যায়নি। তবে মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ এক্ষেত্রে নিজের প্রতি সহানুভুতিশীল হতে। কাছের মানুষের সঙ্গে নিজের অনুভূতির সবটা শেয়ার করলে, তার থেকে মানসিক জোর পেলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। যা ইমপোস্টার সিনড্রোম নিরাময়ে কিছুটা সহায়ক হতে পারে।


ইম্পোস্টার সিনড্রোম কী ?

ইম্পোস্টার   হল ছদ্মবেশী, ভণ্ড ও প্রতারক। আর সিনড্রোম (Syndrome) মানে হলো লক্ষণ। অর্থাৎ ইম্পোস্টার সিনড্রোম হলো— এমন এক ধরনের মানসিক অবস্থা, যেখানে মানুষ তার নিজের অর্জন, সাফল্য, যোগ্যতা ও খ্যাতিকে সন্দেহের চোখে দেখে। নিজেকে অযোগ্য বলে মনে করে। তার মনে হতে থাকে নিছকই ভাগ্যগুণে সে এখানে অবস্থান করছে। সে যে যোগ্য নয়, এই বিষয়টি সবার সামনে ক্রমশ প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে বা যাবে। এই মানসিক অবস্থার নাম ইম্পোস্টার সিনড্রোম।

১৯৭৮ সালে Dr. Pauline R. Clance এবং Dr. Suzanne A. Imes তাদের প্রবন্ধে ইম্পোস্টার সিনড্রোম নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, অনেক সাফল্য পাওয়া নারীর মধ্যে এটি দেখা যায়। তাঁরা মূলত সেসব নারীদের নিয়েই গবেষণা করেন। পরে অবশ্য, বিভিন্ন রিসার্চ থেকে জানা যায় যে, শুধু নারী নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই ইম্পোস্টার সিনড্রোমের মধ্যে দিয়ে যায়।


‘দ্য সিক্রেট থটস অব সাক্সেসফুল উইমেন’ বইয়ের লেখক ভ্যালেরি ইয়াং একজন ইম্পোস্টার সিনড্রোম বিশেষজ্ঞ। ইম্পোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আচরণে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য তিনি খুঁজে পেয়েছেন:


পারফেকশনিস্ট  

পারফেকশনিস্ট মানুষজন তাদের কাজেকর্মে সবকিছুতেই নিখুঁত হতে চেষ্টা করেন। ৯৯% শতাংশ সফল হলেও তারা নিজেকে ব্যর্থ মনে করেন। নিজেদের দোষারোপ করে তাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন। কারণ ১০০% পারফেকশন না থাকলে সেই সাফল্যকে তারা সাফল্য হিসেবে মানতে চান না।


সহজাত প্রতিভাবান  

কিছু মানুষ আছে, যারা জন্ম থেকেই প্রতিভাবান। এমন ন্যাচারালি জিনিয়াস মানুষজনের মধ্যে মাঝে মাঝে একটা ধারণা জন্মায় যে, কোনো কাজ তারা একবারের চেষ্টাতেই পারবেন। কোনো কাজে তাদের বেশি পরিশ্রম দিতে হবে না। কিন্তু কোনো কাজে তারা যদি সেটা করতে না পারেন বা অন্য কথায়, যদি তারা কোনো কিছু আয়ত্ত করতে দীর্ঘ সময় নেন, তবে তারা লজ্জা বোধ করেন। তখন তাদের মধ্যে ইম্পোস্টার সিনড্রোম দেখা দেয়।


 সুপারম্যান বা সুপারওম্যান  

এই ধরনের  ব্যক্তিরা নিজেদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখতে বদ্ধপরিকর। আশেপাশের মানুষের চেয়ে তারা সর্বদা একধাপ বেশি পরিশ্রম করতে চান, শুধু এ কারণে যে, তাদের প্রমাণ করতেই হবে, তারা অযোগ্য নন। একজন ইম্পোস্টার নই আমি—শুধু এ ধারণাটি প্রতীয়মান করার জন্য তারা সবসময় নিজেদের ওপর চাপ তৈরি করতে থাকেন।


একাকী মননের ব্যক্তি  

‘আমার কারও সাহায্যের দরকার নেই আমি সব নিজেই করতে পারবো’—এই ধরনের স্বাধীনচিন্তা থাকা ভালো। পরনির্ভর না হয়ে নিজের প্রতি দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু যদি কেউ সর্বদা অন্যের সাহায্যকে প্রত্যাখ্যান করে সর্বদা একলা চলো নীতিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন এইভেবে যে, কারও কাছে সাহায্য চাইলে তাকে অন্যেরা প্রতারক বা ব্যর্থ মনে করতে পারে। এই ভয়ে সে নিজেকে সাহায্য চাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখেন তবে বিষয়টি ইম্পোস্টার সিনড্রোম এর ইঙ্গিত দেয়।


বিশেষজ্ঞ  

বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা যেকোনো কাজে হাত দেওয়ার আগে সে সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। আর তারা মনে করেন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের সব তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। কর্মক্ষেত্রে বা কোনো মিটিং চলাকালীন তারা কোনো রকম প্রশ্ন করেন না। কারণ তাদের ভেতর ভয় কাজ করে, তারা ভাবে যদি ওই প্রশ্ন তাকে অন্যদের সামনে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয় বা সবাই তাকে বোকা মনে করেন, গবেষণায় জানা যায় ৭০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো সময় ইম্পোস্টার সিনড্রোমে ভোগেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বা নানান পেশার মানুষ যেমন মায়া অ্যাঞ্জেলো, মিশেল ওবামা, অস্কার জয়ী অভিনেতা টম হাংকস বা পেনেলোপ এই বিখ্যাত মানুষগুলোও এই ইম্পোস্টার সিনড্রোমে ভুগেছেন।


যেভাবে কাটিয়ে উঠবেন

নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। আপনি একা নন। আপনার অনুভুতিগুলো প্রিয়জনদের সঙ্গে শেয়ার করুন। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই সমস্যার সম্মুখীন। নিজের কাজকে নিজে স্বীকৃতি দিন। তাহলে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়বে। নিজের অর্জন ও যোগ্যতার একটি তালিকা তৈরি করুন। ভাগ্যই আপনার সব অর্জনের মূলে কিন্তু যখন কাগজে আপনার অর্জনগুলো লিখবেন তখন মনে হবে এ চিন্তা হাস্যকর।


যারা পারফেকশনিস্ট তাদের একটা ভালো দিক হলো—তারা কোনো কাজ অতি যত্ন সহকারে করতে চান। নিখুঁত করে তুলতে নিয়মিত পরিশ্রম করেন। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে যে , এই কাজের জন্য একেবারে যন্ত্রের মতো অমানবিক ভাবে খাটলে চলবে না। রুটিনের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে একটু রিলাক্স ভাবে কাজ করবে হবে । আর কাজে কোনো ভুল হলে নিজেকে ক্ষমা করতে হবে।


সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতাকেও মেনে নিতে শিখুন। কারণ সাফল্যের সিঁড়িই হল ব্যর্থতা। নিজেকে নিজে মূল্যায়নের আগে অন্যের ফিডব্যাক গ্রহণ করুন। কারণ অন্যের চোখে দেখা নিজেকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। সবারই আলাদা আলাদা ক্ষমতা সম্পন্ন । তাই অন্যের সঙ্গে তুলনা না করে নিজের পূর্বের কাজের সঙ্গে বর্তমান কাজের দক্ষতার তুলনা করুন ।


মনে রাখবেন, আপনার জীবনের একটি মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। আপনার জীবনে আপনিই সেরা। আর আপনি নিজেকে যতটা ভাবেন, তার চেয়েও বেশি ক্ষমতা আপনার আছে । নিজেকে আপনি যতটুকু স্মার্ট মনে করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট আপনি। আর যতটুকু কৃতিত্ব নিজেকে দিয়ে থাকেন তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি কৃতিত্ব ধারণের অধিকার আপনার রয়েছে। তাই এই কথাগুলো আপনি নিজেকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলবেন না। মনে রাখবেন আপনার চেয়ে আপন কেউ নেই আপনার, যে আপনাকে উজ্জীবিত করে তুলতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.