বৈপরীত্যে ভরপুর ছিলেন ওপেনহাইমার, প্রকাশ্য সহানুভূতি ছিল সাম্যবাদের প্রতি

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ১৯০৪ সালে নিউ ইয়র্কের একটি বিত্তশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার। ছোটবেলা থেকেই তার চরিত্রে দেখা গিয়েছিল বিপরীতধর্মী রূপ। চরিত্রের এমন খামখেয়ালিপনার দরুন মনোবিজ্ঞানীর সামনে সিজোফ্রেনিয়ার পরীক্ষায়ও বসতে হয়েছিল তাকে।


কখনো ভীষণ উদারচিত্তের মানুষ, আবার কখনো বেশ রুক্ষ আচরণ। দুইবার খুন করতে গিয়েছিলেন। মানুষ হিসেবে শান্তিবাদী, কিন্তু ঘোড়ায় চড়লে উত্তেজনার লাগাম ধরে রাখতে পারতেন না। কেউ মারাত্মক অপছন্দ করত, কেউ কেউ আবার তাকেই আদর্শ হিসেবে মেনেছিলেন। ওপেনহাইমারের চরিত্র এমনই রহস্যময় আর দ্বিধাবিভক্ত ছিল।


তীব্র মেধাবী একজন মানুষ ছিলেন ওপেনহাইমার। শক্ত শক্ত ভাষা সহজেই শিখে ফেলতে পারতেন। ডাচ আর সংস্কৃত কয়েক মাসের মধ্যে শিখে নিয়েছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের যেকোনো তত্ত্ব — তা সেটা যতই জটিল হোক না কেন — খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারতেন।


ইউরোপে পড়ার সময় নিলস বোরের সঙ্গে দেখা হয় তার। বোর ছিলেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার শুরুর দিকের পণ্ডিতদের একজন — বলা যায় পদার্থবিজ্ঞানের এ শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ওপেনহাইমার ইউরোপে পড়ালেখা শুরু করে যখন দেশে ফিরে এলেন, বুঝলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তখনো কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে বিশেষ কোনো ধারণাই তৈরি হয়নি।


ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন, তাত্ত্বিক হিসেবে ওপেনহাইমারে চিন্তাভাবনা চমৎকার, কিন্তু গণিতের বেলায় তিনি ভুল হিসাব করেন। গণিতে প্রায়ই ব্যর্থ হতেন ওপেনহাইমার। আর গবেষণাগারে তিনি ঢুকলেই কিছু না কিছু ভন্ডুল করে বসতেন।


গণিতটাও তাও পরে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অন্য সমস্যাটার সমাধান নিয়ে তিনি মাথাই ঘামাননি। একবার তার ইহুদি বন্ধু ও বিখ্যাত পদার্থবিদ ইসিডর রাবি বলেছিলেন, খ্রিস্টানধর্মে রক্ত ও কোমলতার মতো দুই বৈপরীত্যের সমন্বয় তিনি কখনো বুঝতে পারেননি। ওপেনহাইমার তার বন্ধুকে বলেছিলেন: 'ঠিক সেটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে।'


জার্মান বিজ্ঞানী স্ট্রসম্যান, হান, ফ্রিশ ও মেইটনার নিউক্লিয়ার ফিশন নিয়ে কাজ শুরু করার পর আইনস্টাইন ও হাংগেরিয়ান-আমেরিকান বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টকে চিঠি লিখে সতর্ক করেন, জার্মানির হাতে পারমাণবিক বোমা তৈরির পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনজম-বিরোধী মনোভাব তখন বেশ প্রবল। এদিকে ইউরোপে নাৎসিরা শক্তিশালী হলে সেখানে ওয়াশিংটনের ভবিষ্যৎ ভূমিকা কী হবে তাও অস্পষ্ট।


পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজটা একপ্রকার মহাযজ্ঞ। এর জন্য দরকার কয়েক হাজার মানুষের সমন্বিত কার্যক্রম। লাগবে দেশের সব সেরা পদার্থবিদ ও প্রকৌশলীদের। আর খরচটাও হবে বিশাল। কিন্তু নাৎসি জার্মানি এমন শক্তি অর্জন করবে আর আমেরিকা বসে থাকবে, তা হয়না।


প্রকল্পটির নাম দেওয়া হলো ম্যানহাটন। কারণ ওখানেই মার্কিন আর্মি কোর অভ ইঞ্জিনিয়ার্স-এর সদরদপ্তর। কিছুদিন আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভবনটি — পেন্টাগন — নির্মাণে নির্দেশনা দিয়েছেন মেজর জেনারেল লেসলি আর. গ্রোভস। ম্যানহাটন প্রজেক্টের পরিচালকও হলেন তিনি।


কিন্তু বিজ্ঞানীদলের নেতৃত্ব দেবেন কে? ওয়াশিংটন এ নিয়ে বিস্তর দ্বিধায় পড়ল। মেধা, নেতৃত্ব, জ্যেষ্ঠতা, নাৎসিদের বোমা তৈরির প্রকল্পে জড়িত থাকা জার্মান বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগতভাবে চেনাসহ আরও অনেক গুণের কারণে এ দায়িত্বে আদর্শ ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার।


কিন্তু কমিউনিজমের প্রতি প্রকাশ্য সহানুভূতি ছিল ওপেনহাইমারের। এ একটা কারণই পরিচালকের পদের জন্য অনুপযুক্ত হতে যথেষ্ট। কিন্তু জেনারেল গ্রোভসের ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত প্রজেক্টের বৈজ্ঞানিক পরিচালক হন প্রথাবিরোধী চরিত্রের ওপেনহাইমার।


কেবল আড়াই বছরের মধ্যে সাফল্য পায় ম্যানহাটন প্রজেক্ট। মানব ইতিহাসের অন্যতম সফল বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা এটি। কিন্তু এর ফলাফল দেখে মনে করা হয়েছিল, বিজ্ঞানের সমাপ্তি বা নিদেনপক্ষে পদার্থবিজ্ঞানের সমাপ্তি বুঝি এ প্রজেক্টের মাধ্যমেই শুরু হলো।


রুজভেল্টের মৃত্যুর পর হ্যারি এস. ট্রুম্যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন। ম্যানহাটন প্রজেক্টের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা তাকে পছন্দ করেননি। তারা আশঙ্কা করেছিলেন ট্রুম্যান সেনাবাহিনীর দাবির কাছে বশ্যতা স্বীকার করে পারমাণবিক বোমাটি নিরস্ত্র, পরাস্ত বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নিক্ষেপ করবেন।


জার্মানি ততদিনে ভূমিযুদ্ধে পরাভূত। হিটলার আরও কয়েকমাস আগে আত্মহত্যা করেছেন। ওদিকে নাপাম বোমায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর আত্মসমর্পণের ধারাগুলো নিয়ে আলোচনা করছিল জাপান।


বেশ কয়েকমাস আগে ম্যানহাটন প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা রাশিয়ান বিজ্ঞানীদেরকে প্রজেক্টের সদরদপ্তর লস আলামোসে আমন্ত্রণের প্রস্তাব জানিয়েছিলেন মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে। কারণ তারা বিশ্বাস করেছিলেন, এ মিশন যত গোপন থাকবে, পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা আরও বাড়তে থাকবে।


রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণের প্রস্তাবের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন নিলস বোর। কিন্তু শোনা যায়, তার এ প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা আর বিরোধিতা করেছিলেন উইনস্টন চার্চিল।


নোলানের সিনেমায় এসব নাটকীয়তা আরও স্পষ্ট দেখতে পাবেন দর্শকেরা। সেই সঙ্গে কিলিয়ান মার্ফির অভিনয়ে ফুটে উঠবে ২০ শতকের অন্যতম সফল ও 'ডিস্টার্বিং' একটি চরিত্রের জটিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য।


তবে আমার কী মনে হয় জানেন, আমাদের মতো বিজ্ঞানীদের, বিশেষ করে প্রগতিশীল ঘরানার বিজ্ঞানীদের যদি ম্যানহাটন প্রজেক্টে যুক্ত হওয়ার আর এর ভয়ানক ফলাফলে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে আমরাও রাজি হয়ে যেতাম।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.