রিকন্ডিশনড গাড়ি কিনতে চান? লক্ষ রাখবেন যেসব বিষয়...



 ODD বাংলা ডেস্ক: দৈনন্দিন জীবনে সময় বাঁচানো এবং যাতায়াতের সুবিধার লক্ষ্যে যে বাহনটির কথা মানুষ সবচেয়ে বেশি স্মরণ করে সেটি হচ্ছে গাড়ি। বাসের ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে শান্তির যাত্রার জন্য গাড়ি অনেকেরই পছন্দের তালিকার উপরে থাকে। দেশীয় প্রেক্ষাপটে উচ্চবিত্তের কাছে গাড়ি কেনাটা তুলনামূলক সহজ হলেও দুর্মূল্যের বাজারে উচ্চমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তের নতুন গাড়ি কেনা অনেকটা কঠিনই বটে।


তা বলে কি শখ পূরণ করতে নেই? আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে বিলাসবহুল বাহন হিসেবে গাড়ি অনেকের কাছেই শখের তোলা। তাই শখ আর সাধ্য যখন একসাথে পূরণ করা কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন অনেকেই বেছে নেন রিকন্ডিশনড গাড়ি বা 'সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি'।


রিকন্ডিশনড বা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি হয়তো একেবারে ঝা চকচকে নতুন গাড়ির মত অনুভূতি দেয় না। কিন্তু দেখেশুনে কিনতে পারলে এই গাড়িগুলোও চলে দীর্ঘদিন। যা একদিকে বিলাসিতাও মেটাবে, অপরদিকে পকেটকেও খানিকটা আরাম দেবে। রিকন্ডিশনড গাড়ি বলতে মূলত বেশ কিছু সময় ব্যবহারের পর রিপেয়ার করে বাজারে ছাড়া গাড়িগুলোকেই নির্দেশ করে।


ভারতে আমদানি হওয়া গাড়ির প্রায় ৭৫ শতাংশ রিকন্ডিশনড বা পুরাতন গাড়ি। ১ থেকে ৫ বছরের পুরোনো এসব গাড়ি আমদানি খাতে কাস্টমসের শুল্ক বাবদ আয় হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। আমদানির বাকি ২৫ শতাংশ গাড়িগুলো 'ব্র্যান্ড নিউ'। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য মতে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে ১৭ হাজার ৫০৯টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এসব গাড়ি আমদানির পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৫০ লাখ ৯০ হাজার ডলার।


জাপানের রিকন্ডিশনড গাড়ি


ভারতে রিকন্ডিশনড গাড়ির সিংহভাগই আনা হয় জাপান থেকে। যত্নশীল ও আদর্শ জাতি হিসেবে পরিচিত জাপানে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক গাড়ি প্রস্তুত করা হয়। আপসহীন মানের জন্য তাদের গাড়ির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। জাপানিদের গাড়ির ব্যবহার চক্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা কয়েক বছর ব্যবহারের পরেই গাড়ি বদল করে নতুন গাড়ি কেনেন। যার কারণে নির্দিষ্ট সময় পর অনেক গাড়ি জমে যায় জাপানে। সেসব গাড়িই জাপানের সরকার অকশনে বা নিলামে তোলে। পরবর্তী সময়ে রিকন্ডিশনড গাড়ি হিসেবে সেগুলোই দেশে আসে।


মান ভালো থাকায় বহু বছর ধরে ব্যবহার করার পরেও জাপানের গাড়ি বেশ ভালো থাকে। গুরুতর কোনো সমস্যা ছাড়াই এসব গাড়ি চলতে পারে হাজার হাজার মাইল। জাপানি রিকন্ডিশনড গাড়ির পুনঃবিক্রয়মূল্যও এজন্য ইউরোপ বা আমেরিকার গাড়ির তুলনায় বেশি থাকে।


নজর দিতে হয় মাইলেজে


মাইলেজের কথা বলতেই হীরা আহমেদ উল্লেখ করেন অকশন পেপারের কথা। অকশন পেপার হলো এমন একটি কাগজ যেখানে গাড়ির সবকিছুর বিশদ বর্ণনা দেয়া থাকে। গাড়ি পূর্ববর্তী সময়ে কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে কি-না কিংবা গাড়ি কত মাইল চলেছে সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ অকশন পেপারে থাকে। অকশন পেপারে লিখিত গাড়ির মাইলেজের উপর ভিত্তি করে গাড়ির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। রিকন্ডিশনড গাড়ির মাইলেজের উপর ভিত্তি করে দাম ওঠানামা করে। মাইলেজ কম হলে বা কম সময় রাস্তায় চললে দাম কিছুটা বেশি পড়ে। পাশাপাশি যদি মাইলেজ যদি বেশি হয় বা বেশি সময় ধরে রাস্তায় চলে, তাহলে গাড়ির দাম কিছুটা কম হয়।


গাড়ির মাইলেজ নিয়ে অনেকের মনে অনেক রকমের ধারণা থাকে। অনেকেই মনে করেন, গাড়ি যদি ব্যবহার না করে রেখে দেওয়া হয় তাহলে মাইলেজ কম হবে। আর মাইলেজ কম হলে বিক্রির সময় গাড়ির মূল্য বেশি পাওয়া যাবে। এই ধারণাটি আসলে ভুল। ব্যবহার না করে গ্যারেজে দীর্ঘদিন গাড়ি রেখে দিলে এক নজরে দেখতে ভালো মনে হতে পারে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আসলে গাড়ির ক্ষতি হতে থাকে। দীর্ঘদিন পার্কিং করা থাকলে গাড়ির রাবার, সিল, গ্যাসকেট অনেকটা ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। প্রাত্যাহিক জীবনে ব্যবহারের জন্য এ ধরণের গাড়ি একেবারেই উপযুক্ত নয়। তাই রিকন্ডিশনড গাড়িই হোক বা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি- ব্যবহারের মধ্যে থাকলে গাড়ির নাটবল্টুও ভালো থাকে।


অকশন পেপার পেতে চাইলে


হীরা আহমেদ বলেন, 'একজন ক্রেতা চাইলে ডলার ব্যবহার করে জাপানের অরিজিনাল অকশন পেপার চেক করতে পারে। তখন চেক করে দেখতে পারে আসলেই গাড়িটি অকশনে ছিল কি-না। যদি বলা হয় গাড়িটি চল্লিশ হাজার মাইল চলেছে জাপানে, তাহলে সেটাই অকশন পেপারে শো করবে। গাড়িতে টুকটাক স্ক্র্যাচ অথবা ভাঙ্গা থাকলে তাও অকশন পেপার শো করবে।'


অকশন পেপার কীভাবে পাওয়া যাবে জানতে চাইলে হীরা আহমেদ বলেন, 'অকশন পেপার গাড়ির ডকুমেন্টের সাথেই থাকে। আবার অনেক সময় ডকুমেন্টের সাথে না থাকলে ইঞ্জিন চেসিস নাম্বার নিয়ে ট্রু রিপোর্ট বের করতে পারবেন। ট্রু রিপোর্ট বের করলে সেটা চলে আসবে।'


কত পুরোনো গাড়ি কেনা ভালো


গাড়ি কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছে সেটা তার ওডোমিটারের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে। ওডোমিটার এমন একটি যন্ত্রাংশ যা সংশ্লিষ্ট গাড়ি দ্বারা ভ্রমণ করা দূরত্ব দেখায়। গাড়িতে ওডোমিটার থাকলে মাইলেজ কত তা যাচাই করা সহজ হয়।


স্প্যানিশ গণমাধ্যম এল পাইসের একটি প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, একটি পাঁচ বছর বয়সী গাড়ির মাইলেজ গড়ে ৬০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ পর্যন্ত হতে পারে। একইভাবে একটি দশ বছর বয়সী গাড়ির মাইলেজ ১,২০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ পর্যন্ত থাকতে পারে। গাড়ি কোনো চিরস্থায়ী বাহন নয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর তা মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। গাড়ির মাইলেজ যত বাড়ে, তার রক্ষণাবেক্ষণের খরচও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। তাই সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি বা রিকন্ডিশনড গাড়ি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দশ বছরের বেশি পুরোনো গাড়ি এড়িয়ে চললে ভালো হয়।


গাড়ি কেনার সময় ক্রেতার ভাবনা


গাড়ি যেহেতু একটি দীর্ঘকালীন বিনিয়োগ। তাই রিকন্ডিশনড গাড়ি অথবা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনলেও দেখেশুনে যাচাই করে কেনাই বাঞ্ছনীয়। কেনার সময় ক্রেতাকে মাথায় রাখতে হয় একাধিক বিষয়। এ বিষয়ে কথা হয় রাজধানীর ওয়াটার গিজার ব্যবসায়ী তানভীর অপুর সাথে। আট মাস আগে তিনি 'এক্স করোলা' নামক একটি সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনেছেন। অতীতে গাড়ি কেনার অভিজ্ঞতা থাকায় এই গাড়িটি কেনার সময়ও অনেককিছু মাথায় রেখেছেন তিনি।


সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার বিষয়ে তানভীর অপু বলেন, 'প্রথমেই দেখতে হয় গাড়ির ইঞ্জিন কন্ডিশন কেমন আছে। গাড়ি চালালে এটি বোঝা যায়। গাড়ির স্মুথনেস, সাউন্ড, গাড়ির শক্তি এগুলা ইঞ্জিন কন্ডিশনের উপর নির্ভর করে। গাড়ির গিয়ারবক্স ভালো আছে নাকি সেটাও দেখতে হয়। সঠিক স্পিডে গিয়ার চেঞ্জ হচ্ছে কি-না, গিয়ার চেঞ্জ হওয়ার সময় গাড়ি ধাক্কা দিচ্ছে কি-না, শব্দ করছে কি-না এই বিষয়গুলো গিয়ারবক্সের মানের উপর নির্ভর করে।'


পুরাতন গাড়ি কেনার সময় সর্বদা স্টিয়ারিং এর দিকে লক্ষ্য রাখেন তানভীর অপু। স্টিয়ারিং বক্স সঠিক থাকার পাশাপাশি স্টিয়ারিং সঠিকভাবে ঘোরানো যাচ্ছে কি-না সেদিকে নজর দেন তিনি। তাছাড়া গাড়ির জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে গাড়ির টায়ার। গাড়ির টায়ারের এলাইনমেন্ট সাধারণত একইরকমভাবে বিন্যস্ত হওয়ায় তার মধ্যে কোনো ড্যামেজ আছে কি-না তা যাচাইয়ের প্রতিও গুরুত্ব দেন তিনি।


সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার সময় গাড়ির সামনের ও পেছনের গ্লাসগুলো অরিজিনাল কি-না সেটাও খেয়াল রাখার কথা বলেছেন তানভীর অপু। তিনি বলেন, 'গাড়ির এক্সিডেন্ট হলেই গ্লাস বদল করা হয়। এক্ষেত্রে গাড়ি কোন দুর্ঘটনায় পড়েছিলো নাকি সেটিও দেখা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ বডি ড্যামেজড গাড়ি চালানোর জন্য ভারসাম্যহীন এবং পরবর্তীকালে বিক্রয় করতে গেলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়, ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না।'

সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার সময় ফ্রেম ড্যামেজ গাড়ি কিনতে নিরুৎসাহিত করা হয়। গাড়ির রং ভালোভাবে দেখার পাশাপাশি যন্ত্রাংশে কোনোরূপ মরিচা পড়েছে কি-না অথবা দাগ আছে কি-না সেটিও যাচাই করা প্রয়োজন পড়ে। গাড়ির সঠিক পরিচর্যা হয়েছে কি-না সেটি তার হুডের দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে। তাছাড়া গাড়ির বেল্ট, গাড়ির ব্রেকিং প্যাড কতটুকু ভালো আছে তার দিকেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন।


সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার জন্য ট্যাক্স টোকেনের মেয়াদ কতোদিন আছে তা খেয়াল রাখতে বলেছেন তানভীর অপু। তিনি বলেন, 'ফিটনেস সার্টিফিকেটের সাথে গাড়ির পার্টসগুলোর সামঞ্জস্যতা আছে কি-না সেটা চেক করতে হয়। পাশাপাশি গাড়ির ফিটনেসের মেয়াদ কতোদিন আছে তাও দেখতে হয়।' গাড়ি তেল, গ্যাস নাকি এলপিজিতে চলবে সেটিও লক্ষ রাখা প্রয়োজন। তার মতে, তেলেচালিত গাড়ির ইঞ্জিন কন্ডিশন ভালো থাকে তুলনামূলক।


সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার জন্য অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর পাশাপাশি গাড়ির বাহ্যিক বিভিন্ন বিষয়, যেমন:  লাইট, টায়ার, লুকিং মিরর, বাম্পার, গ্রিলস, কুলিং ফ্যান, গিয়ার স্টিক, আসন, জানালা, উইন্ড শিল্ড, ওয়াইপার প্রভৃতির দিকেও নজর রাখা জরুরি।


গাড়ি পরীক্ষার জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান

নাভানা টয়োটা থ্রী'এস সেন্টার ছাড়াও ঢাকার ভেতরে গাড়ি সার্ভিসিং করাতে চাইলে ক্রেতারা আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে পারে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে টয়োটা মোটরস অ্যান্ড কারস সার্ভিসিং সেন্টার, ভি টেক অটো সার্ভিস, র‍্যাংগস ওয়ার্কশপ লিমিটেড, ফাইভ স্টার ভেহিক্যাল সলিউশন্স, আসাহি জাপান অটো সলিউশন্স প্রভৃতি।


সর্বোপরি একটি রিকন্ডিশনড গাড়ি বা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার আগে গাড়ির আসল বাজারমূল্য আগে যাচাই করে নেয়া প্রয়োজন। তারপর গাড়ির মাইলেজ এবং গাড়ির বয়স ও আনুষঙ্গিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করা দরকার। রাজধানীর কাকরাইলের সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠান এফআর কারসের ম্যানেজার শামিম বলেন, 'গাড়ি কিনতে আসার সময় একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি সাথে নিয়ে আসলে ভালো হয়। এক্সপার্ট নিয়ে এসে গাড়ি রাস্তায় চালিয়ে দেখে কেনা যেতে পারে।' 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.