আইন দুবাই: বিশ্বের বৃহত্তম ফেরিস হুইল ঘিরে রহস্য
ODD বাংলা ডেস্ক: নাম 'আইন দুবাই'। আরবি ভাষার শব্দ 'আইন'-এর বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় 'দুবাইয়ের চোখ'। বিশ্বের বৃহত্তম ফেরিস হুইলটি আক্ষরিক অর্থেও ছিল এমন কিছুই। আইন দুবাইতে চড়লে পুরো শহরই দেখা যেত। শেষ বাক্যে 'যেত' লেখার কারণ হলো, গত একবছর ধরে রহস্যজনকভাবে বন্ধ আছে আইন দুবাই।
ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের চেয়ে বেশি স্টিল ব্যবহার হয়েছে আইন দুবাইতে। এটি যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ফেরিস হুইল লন্ডন আই-এর উচ্চতার প্রায় দ্বিগুণ। প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছিল, এক মাসের জন্য বন্ধ থাকবে আইন দুবাই। পরে এক মাস এক মাস করে বাড়ানো হয় বন্ধ থাকার মেয়াদ। সর্বশেষ গত এপ্রিলে ঘোষণা আসে, অনির্দিষ্টিকালের জন্য বন্ধ থাকবে দুবাইয়ের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ ফেরিস হুইলটি।
এখন এই ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়ের বিশালকার পিলারগুলোতে ধুলো পড়েছে। একটি কৃত্রিম দ্বীপের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে দুবাইয়ের গর্ব বলে বিবেচিত এই ফেরিস হুইলের এভাবে পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা রহস্যজনক। জাহাজের অগ্রভাগসদৃশ এই কৃত্রিম দ্বীপে বিলাসবহুল সব অ্যাপার্টমেন্ট, ফাইন ডাইনিং, খুচরা দোকান, একটি শপিংমল ও লাস ভেগাসের মতো সিজারস প্যালেসও তৈরি করা হয়েছে। সিজারস প্যালেস নির্মাণের ফলে ইসলামি আইন বাস্তবায়ন করা দেশটিতে জুয়া খেলার অনুমতি দেওয়া হবে বলেও ধারণা করা হয়েছিল। অথচ ফেরিস হুইলটি বন্ধের বিষয়ে কোনো কিছুই জনসমক্ষে জানানো হয়নি। এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বড় বড় প্রকল্পগুলো গোপনে থামিয়ে দেওয়া কিংবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি আবারো সামনে নিয়ে আসছে।
দুবাইয়ে নির্মাণ ব্যবসায়ীদের অবস্থা এখন রমরমা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ধনকুবের, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা পেতে রাশিয়ান অনেক ধনী ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দুবাইতে সম্পত্তি কিনেছেন। ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে দুবাইতে বিক্রি হওয়া অনেক বাড়ির দাম এক কোটি ডলারের বেশি বলে জানা গেছে, যা বিশ্বের অন্য যে কোন জায়গার তুলনায় বেশি। তবে ফেরিস হুইল বন্ধের ঘটনা অতীতে এমন প্রকল্প বাতিলের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন বুর্জ খলিফাসহ চমৎকার সব স্থাপনা থাকা এই শহরে, ২০২১ সালের অক্টোবরে আইন দুবাই চালু করার পর পর্যটকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিন্তু এখন ব্লুওয়াটার্স দ্বীপে, যেখানে আইন দুবাই অবস্থিত, সাপ্তাহিক ছুটিতেও পর্যটকদের ভিড় দেখা যায় না। দ্বীপের বহুস্তরের ভূগর্ভস্থ পার্কিং গ্যারেজও পূর্ণ হয় না। শপিংমলটিও হয়ে উঠেছে দোকান কর্মচারীদের আড্ডার জায়গা।
কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামের স্নাতকোত্তর পাঠদানের পরিচালক আলেড ডেভিস বলেন, 'বিশ্বের সবচেয়ে বড় কিছু তৈরি করার সমস্যা হলো, আপনি যখন একটি নির্দিষ্ট স্কেল অতিক্রম করেন, তখন আপনি অজানা কিছুতে প্রবেশ করবেন। যেখানে সাধারণত ছোট সমস্যাগুলো হঠাৎ বড় হয়ে উঠতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, এই বিষয়ে (আইন দুবাই) কোনো তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি। হয়তো সেখানে কোনো বস্তুগত সমস্যা আছে। অথবা বাতাসের কারণে বেয়ারিং যে পরিমাণ চাপে মানিয়ে নেওয়ার কথা, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তারচেয়ে বেশি চাপ পড়ছে। কিংবা অবকাঠামোতে হয়তো চিড় ধরেছে।
সরকার কোনো কারণ ব্যাখ্যা না করায়, দ্বীপের বাসিন্দারা অনেক কিছু অনুমান করছেন। কেউ কেউ বলছেন, চালু থাকার পাঁচ মাসে ফেরিস হুইলটি জোরে কম্পিত হতো। অন্যরা দাবি করছেন, দ্যৈতাকার কাঠামোটি ঘুরলে মাটিতে ঝাঁকুনি অনুভব হতো। এক ব্যবসায়ী জানান, কম্পনের কারণে জানালা ভেঙে গেছে। কেউ এই ভেবে ভয় পাচ্ছেন যে, কাঠামো তৈরির সময়ই কোনো ভুলত্রুটি হয়েছে। কর্তৃপক্ষের কারণে তাদের মধ্যে কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি।
এক বাসিন্দা বলেন, 'আমি এখানে দুই বছর ধরে বাস করছি। এখানে কী ঘটছে সে বিষয়ে আমাকে কোন কিছুই জানানো হয়নি।'
আরেক বাসিন্দা বলেন, কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা কিছু শুনিনি। তবে ভবন ব্যবস্থাপকদের কেউ কেউ বলছেন আইন দুবাইয়ের মূল কাঠামোর ভিতরে কিছু ভেঙে গেছে। অন্যরা বলছেন এটি ডুবে যাচ্ছে। ফেরিস হুইলমুখী হোটেলগুলোর ম্যানেজারদের থেকে জানা গেছে, আইন দুবাই ধসে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা থেকে তারা ঝুঁকি ও ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করছেন।
৮০০ ফুটের বেশি উঁচু আইন দুবাইকে ১,৪০০ যাত্রী বহনে সক্ষম করে তৈরি করা হয়েছিল। এতে রাতের খাবার, কর্পোরেট ইভেন্ট এবং জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি আয়োজনের ব্যবস্থা ছিল। তবে এখন এই ফেরিস হুইল ও তার চারপাশের অবকাঠামো ঠিক কত আয় করছে তা স্পষ্ট নয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং, কানাডার ডব্লিউএসপি, স্থানীয় ডেভেলপার মেরাস এবং নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ফেরিস হুইল বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান স্টারনেথ মিলে আইন দুবাই তৈরি করে। ফেরিস হুইলটি দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুমের বিনিয়োগ থাকা দুবাই হোল্ডিংয়ের মালিকানাধীন।
কয়েক মাস ধরে বারবার যোগাযোগ করা হলেও, জড়িত কোনো কোম্পানি আইন দুবাইতে কি হয়েছে এবং কীভাবে সংস্কার করা হবে সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
জার্মানির টেকনিক্যাল ইন্সপেকশন অ্যাসোসিয়েশন নিশ্চিত করেছে যে, তারা আইন দুবাই নির্মাণের সাথে জড়িত ছিল, কিন্তু অবকাঠামোর জন্য শংসাপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। অপ্রকাশ্য চুক্তি দ্বারা আবদ্ধ জানিয়ে তারা আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। আইন দুবাইয়ের জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগ করা হলেও কেউ মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
দুবাইতে গত কয়েক বছরে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার পর বাতিল করা হয়েছে, বা মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু ভবন নির্মাণের পর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এমন ব্যয়বহুল প্রকল্পের ব্যর্থতা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ঋণে জর্জর শহরটিকে আবুধাবি থেকে বেইল আউট প্যাকেজ নিতে হয়েছিল।
সম্প্রতি দুবাইয়ের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণাপত্র লেখা অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিক স্নাইডার বলেন, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর দুবাইতে প্রচুর ব্যর্থ প্রকল্প হয়েছে। তিনি দুবাইয়ের অর্থনীতিকে রিয়েল এস্টেটের ওপর নির্ভরশীল হিসেবে বর্ণনা করেন।
দুবাইতে সবসময় নির্মাণ খাত এগিয়ে নিতে প্রণোদনাও দেওয়া হয়। গত মে মাসের শেষের দিকে, কর্তৃপক্ষ পাম জুমেইরাহর মতো দ্বিতীয় পাম দ্বীপের জন্য একটি নতুন মাস্টারপ্লান সম্পন্ন করার ঘোষণা দেয়।
এদিকে আইন দুবাইতে প্রতি রাতে আলোকসজ্জা চলে। যা কয়েক মাইল দূর থেকেও দেখতে পাওয়া যায়। তথ্য বুথের কর্মকর্তা হাসি দিয়ে অস্পষ্টভাবে বলেন, শীঘ্রই এটি আবার চালু হবে।
তবে ব্লুওয়াটার্সের বাসিন্দা ওলেগ বলেন, 'আমি মনে করি শেখরা নিজেদের মুখ বাঁচাতে এটিকে সরাতে চাইবেন না। কারণ এটি দিনশেষে একটি যুগান্তকারী স্থাপনা । সুতরাং আমি মনে করি এটা এখানেই থাকবে।'
Post a Comment