বাস্তবের প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ইন্ডিয়ানা জোন্সকে কীভাবে দেখেন?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ঈশ্বরের কাছ থেকে পয়গম্বর মোজেস (মুসা) যে বিধান পেয়েছিলেন, তা লেখা ছিল কতগুলো প্রস্তর ফলকে। সেগুলো রাখা ছিল সোনার তৈরি বাক্স আর্ক অভ দ্য কোভেন্যান্টে। যুক্তরাষ্ট্রের সেটা চাই, আর তা খুঁজে আনার দায়িত্ব দেওয়া হলো প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক ইন্ডিয়ান জোন্স ওরফে ইন্ডিকে। এ নিয়েই এগিয়েছে ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া রেইডার্স অভ দ্য লস্ট আর্ক সিনেমার গল্প।


তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধবে বাধবে করছে। নাৎসিরাও আর্ক অভ দ্য কোভেন্যান্ট পাওয়ার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছে, তাদের লক্ষ্য আর্কের বিধ্বংসী ক্ষমতাকে জয় করে সেটাকে কাজে লাগানো। তবে বাস্তবেও সে সময় জার্মানরা এসবের পেছনে পড়ে ছিল।


১৯৩৯ সালে স্পেনের ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর সরকার ও জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের সরকার মিলিত হয়ে আর্য হতে উৎপত্তি প্রদর্শনের জন্য ভিসিগথদের মহাগোরস্তান খোঁড়ার কাজ শুরু করে। স্পেনের এক শহরের ওই গোরস্তান থেকে প্রায় ৪০০-এর বেশি কবর খুঁড়ে মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে জার্মানিতে পাঠানো হয়।


স্পিলবার্গের সিনেমায় আর্ক অভ দ্য কোভেন্যান্টের শেষতক স্থান হয় যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদার গোপন সামরিক ঘাঁটি এরিয়া ৫১-এ। আর ভিসিগথদের গোরস্তান থেকে পাওয়া বস্তুগুলো রাখা হয়েছিল জার্মানির নুরেমবার্গের গেমানিশাস নাতসোনালমুজিয়ম-এ। সেখান থেকে পরে আর সেগুলোকে কোথাও সরানো হয়নি।


প্রত্নতাত্ত্বিক এসপারেঞ্জা মার্তিন ঐতিহ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব নিয়ে কাজ করেন। তার মতে, 'ইন্ডি সিনেমাগুলোর ভালো ও খারাপ দুটো দিকই আছে। এ ফ্র্যাঞ্চাইজের প্রোটাগনিস্ট (হ্যারিসন ফোর্ড) শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি। কিন্তু তার মধ্যে আবার সহজাত ধ্বংসপ্রবণতা রয়েছে। ইন্ডি এমন একজন ব্যক্তি যিনি মিথিক্যাল গুপ্তধন খোঁজার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ধ্বংস করেন।'


মার্তিনের মতে, হলিউডের সিনেমাগুলোতে পেশাদার মানুষদেরকে 'অভিযাত্রী, নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামরত, বাস্তববর্জিত, এবং নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে সবকিছু ধ্বংস করতেও সক্ষম গুপ্তধন শিকারি' হিসেবে দেখানো হয়।


ওপেন ইউনিভার্সিটি অভ কাতালোনিয়া'র প্রাক-ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও মানব বিবর্তনের কোলাবোরেটিং প্রফেসর হোর্দি সেরালোঙ্গা মার্কিন সিনেমারা বড় ভক্ত। 'আমি মাথায় ফেডোরা (ইন্ডি'র পরা টুপি) চাপাই, আর যেকোনো জঙ্গল, মরুভূমি, সাভানা, পর্বত কিংবা সমুদ্র একটা গল্পের সেটিংয়ে পরিণত হয় — যেখানে জোন্সের স্মৃতি সবসময় আমার সঙ্গে থাকে।'


ইন্ডিয়ানার ব্যবহৃত জিনিসপত্র উপহার দেওয়ারও চল আছে ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। ইউনিভার্সিটি অভ ভ্যালাডোলিড-এর প্রাক-ইতিহাসের অধ্যাপক ম্যানুয়েল রোহো স্বীকার করেছেন, তিনি একবার তার এক সঙ্গী গবেষকের জন্মদিনে একটি ইন্ডিয়ানা জোন্স হ্যাট ও চাবুক উপহার দিয়েছিলেন।


তবে রোহো বলেন, 'এ ধরনের সিনেমা নিয়ে আমার মতামত ইতিবাচক নয়। কারণ এগুলোতে প্রত্নতত্ত্বের প্রকৃত বাস্তবতার কোনো প্রতিফলন থাকে না। এটি একটি পুরোদস্তুর সিনেম্যাটিক অ্যাডভেঞ্চার যেখানে প্রত্নতত্ত্বকে স্রেফ অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।'


'অনেক শিক্ষার্থী হয়তো ইন্ডিয়ানা জোন্সের সিনেমাগুলো দেখে আমাদের ডিসিপ্লিনে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব খুবই শ্রমসাধ্য, মারাত্মক, গবেষণাধর্মী কাজ। সিনেমায় দেখানোর সঙ্গে এর আদতে কোনো মিল নেই,' বলেন ম্যানুয়েল রোহো।


'আমাদের কাজে সবসময় সমাপ্তির দেখা মেলে না। আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে কাজ করি, প্রকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করি বৈজ্ঞানিক উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য। আর আমরা গুপ্ত দরজা খুঁজে পাওয়ার জন্য ভবন উড়িয়ে দিই না,' অন্য সহকর্মীদের মতোই একসুরে বলেন রোহো।


অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অভ বার্সেলোনা'র প্রাক-ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ভিসেন্তে লাল বলেন, 'ইন্ডিয়ানা জোন্স প্রত্নতত্ত্বকে জনপ্রিয় করতে অবদান রেখেছেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনিই আবার বিষয়টিকে খেলো করে ফেলেছেন।'


স্পিলবার্গের ইন্ডিয়ান জোন্স একাই সারাবিশ্বে ভ্রমণ করেন। আর্থিকভাবে তাকে কখনো সংকটে পড়তে হয় না। কিন্তু বাস্তবে একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের জীবন এত সহজ নয়। তাদের খোঁড়াখুঁড়ির জন্য বাজেটের পরিমাণ অসীম থাকে না। গবেষণার জন্য তাদেরকে ইন্টার্ন বা সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের অর্থ খরচ করে নিয়োগ করতে হয়। আবার শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলোর জন্য বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়োগের দরকার হয় অনেকক্ষেত্রেই।


এসপারেঞ্জা মার্তিন বলেন, ইন্ডিয়ানা জোন্সের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হলো, শেষ পর্যন্ত মিথিক্যাল আর্ক অভ দ্য কোভেন্যান্টের আশ্রয় হয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক গুদামঘরে। যার দরুন ওই বস্তু দেখার সুযোগ হয় না কারও, এটির শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করতে পারেন না কেউ।


মার্তিনের মতে, আর্কটি বরং জাদুঘরে রাখা উচিত ছিল, কারণ সেটিই বস্তুটির জন্য প্রকৃত স্থান। যদিও ভিসিগথদের গোরস্তানের ধন-সম্পদ আর অন্যান্য বস্তুসূমহ নুরেমবার্গের জাদুঘরে রাখা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোও ওসব বস্তু যেখান থেকে চুরি হয়েছে তার থেকে ১,৮৪৪ কিলোমিটার দূরে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.