তিমির হানা, নৌকায় আশ্রয়, বাধ্য হয়ে নরমাংসভোজন: মবি-ডিক লেখার অনুপ্রেরণা বাস্তবের এসেক্স

 


ODD বাংলা ডেস্ক: তিমির হানা, নৌকায় আশ্রয়, বাধ্য হয়ে নরমাংসভোজন: মবি-ডিক লেখার অনুপ্রেরণা বাস্তবের এসেক্স

১৮১৯ সালের আগস্টে প্রশান্ত মহাসাগরে একটি স্পার্ম হোয়েলের আক্রমণের মুখে ডুবে যায় তিমিশিকারি জাহাজ এসেক্স। তিনটি নৌকা, ২০ জন নাবিক, অল্প খাবার ও রসদ — লক্ষ্য উদ্ধার হওয়া। কিন্তু দিনের পর দিন সমুদ্রে ভাসার পরও ডাঙা বা অন্য কোনো জাহাজের দেখা নেই। খাবারও শেষের দিকে। শেষে বাধ্য হয়ে মৃত নাবিকদের খেতে শুরু করলেন তারা। পরবর্তী খাদ্য কে হবে, তার জন্য লটারিও করেছিলেন তারা। ২০ জন থেকে সংখ্যা নেমে এল এক অংকের ঘরে…


মোচা ডিক বধ। ১৮৩০-এর দশকে মোচা ডিক নামক একটি বিশালাকৃতির স্পার্ম হোয়েল অনেকগুলো তিমিশিকারির জাহাজ পরিকল্পিত আক্রমণের মাধ্যমে ডুবিয়ে দিয়েছিল বলে জানা যায়। মোচা ডিক-এর ঘটনা থেকেও 'মবি-ডিক' লেখার কিছুটা অনুপ্রেরেণা পেয়েছিলেন মেলভিল। ছবি: অ্যালামি ভিয়া দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

১৮৫২ সালের জুলাই মাসে মবি-ডিক-এর লেখক হারম্যান মেলভিল নানটাকেটের ম্যাসাচুসেটস দ্বীপে যান। এ জায়গাকে উপজীব্য করেই তিনি তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ক্যাপ্টেন আহাব ও তার জাহাজের মূল বন্দর সৃষ্টি করেছিলেন। নানটাকেট ছেড়ে আসার শেষ দিন 'এসেক্স' নামক এক জাহাজের ৬০ বছর বয়সী কাপ্তানের সঙ্গে দেখা হয় মেলভিলের। সমুদ্রে স্পার্ম হোয়েলের আক্রমণে ১৮২০ সালে এসেক্স ডুবে গিয়েছিল। এ ঘটনা থেকেই উৎসাহিত হয়ে নিজের উপন্যাস লিখেছিলেন মেলভিল।


এসেক্স যখন ডুবেছিল, তখন ক্যাপ্টেন জর্জ পোলার্ড জুনিয়রের বয়স কেবল ২৯ বছর। সে যাত্রায় বেঁচে ফিরে 'টু ব্রাদার্স' নামক আরেকটি তিমি শিকারি জাহাজের দায়িত্ব নেন পোলার্ড। কিন্তু দুবছর পরে সমুদ্রে প্রবাল প্রাচীরের গায়ে ধাক্কা লেগে এটিও বিধ্বস্ত হয়। তখন পোলার্ডের কপালে অপয়া খেতাব জুটে যায়। শেষ পর্যন্ত গ্রামের চৌকিদার হিসেবে বাকি জীবন ডাঙায়ই কাটাতে হয়েছিল ক্যাপ্টেন জর্জ পোলার্ড জুনিয়রকে।


এসেক্স-এর দুর্ঘটনায় উদ্ধার হওয়ার পর একবার খাবার টেবিলে বসে অন্য ক্যাপ্টেন এবং জর্জ বেনেট নামক একজন মিশনারিকে পুরো ঘটনা খুলে বলেছিলেন পোলার্ড। ৯২ দিন একটা ফাটল ধরা নৌকায় পোলার্ড ও তার ক্রুদেরকে সমুদ্রে ভেসে থাকতে হয়েছিল।


মেলভিল যতটুকু জানতে পেরেছিলেন, ১৮১৯ সালের আগস্টে তিমি শিকারের উদ্দেশ্যে আড়াই বছরের জন্য মহাসমুদ্রের দিকে রওনা দিয়েছিল এসেক্স। এর দিন দুয়েক পরে ১৪ আগস্ট প্রথম বিপদের মুখে পড়ে জাহাজটি। হঠাৎ উদয় হওয়া এক ঝড়ে এসেক্সের একটি পাল বিধ্বস্ত হয়, তাতেই জাহাজটি প্রায় ডুবতে বসেছিল। তবে পোলার্ড দক্ষ হাতে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে রাখেন। এ ঝড়ের পাঁচ সপ্তাহ পরে কেপ হর্নে পৌঁছায় বিধ্বস্ত জাহাজটি। কিন্তু সেখানকার জলে মাছের সন্ধান না পাওয়ায় জাহাজের ২০ সদস্যের ক্রু ঠিক করলেন দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের কূল থেকে অনেক দূরের জলে, তিমির রাজ্যে মাছ ধরতে যাবেন তারা।


১৮২০ সালের নভেম্বর, জাহাজ তখন সবচেয়ে কাছাকাছি তট থেকেও হাজার মাইল দূরে। ক্যাপ্টেন পোলার্ড নৌকা নিয়ে তিমি শিকার করতে বেরিয়েছেন। জাহাজের ২৩ বছর বয়সী ফার্স্ট মেট ওয়েন চেজ সবার আগে বিশাল ওই তিমিটিকে খেয়াল করেন। প্রায় ৮৫ ফুট লম্বা তিমিটি বহুদূরে জলের ওপর চুপচাপ শুয়ে ছিল — মাথাটা সরাসরি এসেক্সের দিকে মুখ করা। দুই-তিনবার জলের ফোয়ারা ছোটানোর পর হঠাৎ জাহাজ তাক করে দ্রুতবেগে আসতে শুরু করল তিমিটি। চেজের ভাষায় গতি ছিল মোটামুটি তিন নট। সোজা এসে জাহাজের গায়ে মাথা দিয়ে ধাক্কা দিলো এটি।


তিমিটি জাহাজের নিচ দিয়ে একবার পার হলো। এরপর জলে ঝাপটানো শুরু করল। চেজ ওই দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন এভাবে: 'আমি স্পষ্ট দেখছি এটি চোয়ালে চোয়ালে বাড়ি দিচ্ছে, মনে হচ্ছিল রাগ আর ক্ষোভে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়েছে।' এরপর জলের তলায় হারিয়ে গেল প্রাণীটি।


জাহাজের ক্রুরা ফাটল সারাই আর ঢুকে পড়া জল সরাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। হঠাৎ একজন চিৎকার করে উঠলেন, 'ওই যে — আবার আসছে আমাদের দিকে।' জলের ওপর মাথাটা অর্ধেক তোলা, এবার গতি প্রায় দ্বিগুণ — এসেই সরাসরি ধাক্কা দিলো জাহাজের গায়ে লাগানো ক্যাটহেড নামক একটি কাঠের বিমে। এবারের পর তিমিটিকে আর দেখা যায়নি অবশ্য।


তবে শেষ ধাক্কায় এসেক্সের অবস্থা এমন দফারফা হয়ে গিয়েছিল যে, জলের তোড়ের চাপে ক্রুরা কেবল নৌকা আর কিছু নেভিগেশনের যন্ত্রপাতি, রুটি, জল ও রসদ নামাতে পেরেছিলেন। একটু পরেই জাহাজটি একপাশে কাত হয়ে যায়।


দূর থেকে জাহাজের দুর্দশা দেখেছিলেন পোলার্ড। দ্রুত জাহাজের কাছে এসে অবস্থা দেখে তিনি হতবাক। চেজকে জিজ্ঞেস করলেন রহস্যের কথা। 'একটা তিমি এ দশা করেছে,' ফার্স্ট মেট উত্তর দিলেন। কিছুক্ষণ পরে শিকার থেকে আরেকটি নৌকা ফিরে এল। তারপর নৌকাগুলো উদ্ধারের আশায় যাত্রা শুরু করল — সবাই নিশ্চুপ, বিষণ্ণ।


সব মিলিয়ে তিনটা নৌকা আর ২০ জন মানুষ। নৌকাগুলো ২০ ফুটের মতো লম্বা। তারা হিসেব করে দেখলেন, সবচেয়ে কাছের সমুদ্রতট হচ্ছে মার্কেসাস দ্বীপপুঞ্জ ও সোসাইটি দ্বীপপুঞ্জ। পোলার্ড ঠিক করলেন, নৌকা সেদিকেই নেবেন। কিন্তু চেজ ও অন্য ক্রুরা পোলার্ডকে বোঝালেন, ওসব দ্বীপ নরখাদকে ভর্তি এবং বাঁচতে হলে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হবে দক্ষিণের দিকে যাত্রা করা। হয়তো দূরত্ব বেশি, কিন্তু বাতাস অনুকূলে থাকলে পৌঁছানো অসম্ভব হবে না, এমনকি অন্য কোনো তিমিশিকারি জাহাজের দেখাও মিলে যেতে পারে। পোলার্ড ভাবলেন, সে-ই ভালো।


কিন্তু বিধি বাম, যাত্রার শুরু থেকেই বাধা। সমুদ্রের নোনতা জলে ভিজে রুটি নষ্ট হলো, ক্রুরা একে একে জলশূন্যতায় ভুগতে শুরু করলেন। মাথার ওপর সূর্যেরও কোনো দয়া হচ্ছে না। পোলার্ডের নৌকায় আবার আরেকটা অর্কা তথা কিলার হোয়েল হামলা চালাল। সপ্তাহ দুয়েক পরে হ্যান্ডারসন দ্বীপ দেখতে পেলেন তারা। কিন্তু দ্বীপে কোনো খাবার-জল কিচ্ছু নেই। আরেক সপ্তাহ পর থেকে খাবার ও রসদ শেষ হয়ে আসতে শুরু করল। নৌকায় ধুঁকেধুকে মরার চেয়ে ডাঙায় গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা ভালো — এমন চিন্তা করে তিনজন নাবিক নৌকা ছেড়ে হ্যান্ডারসন দ্বীপে গিয়ে উঠলেন।



ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নৌকাগুলোতে জল ঢুকতে শুরু করল — সেই সঙ্গে যোগ হলো রাতের বেলায় তিমির উৎপাত। জানুয়ারি মাসে রেশন প্রায় শেষের দিকে। চেজের নৌকার একজন অবশেষে উন্মাদ হয়ে গেলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে একটি ডিনার ন্যাপকিন আর জল দাবি করলেন। তারপর তার সারা শরীরে খিঁচুনি তৈরি হলো। পরেরদিন সকালে তিনি মারা গেলেন।


এরপরের ঘটনা যেন নিয়তির পরিহাস। নরখাদকদের ভয়ে কাছের দ্বীপে যেতে চাননি এসেক্সের ক্রুরা। শেষপর্যন্ত তারাই নরমাংসভোজন করতে বাধ্য হলেন। চেজের লেখা থেকে জানা যায়, 'মৃত নাবিকের লাশ থেকে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করলেন বাকি নাবিকেরা। হাড় থেকে সব মাংস কেটে নিলেন। তারপর শরীর ফাঁকা করে ভেতর থেকে হৃৎপিণ্ড বের করে আবার সেলাই করে দেওয়া হলো। এরপর মৃতদেহটি সমুদ্রে বিসর্জন দিলেন তারা।' এরপর একটি সমতল পাথরের ওপর ওই মাংস রোস্ট করে খেতে বাধ্য হলেন এসেক্সের নাবিকেরা।


পরের সপ্তাহগুলোতে আরও তিনজন নাবিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তাদের দেহও রান্না করে খেলেন বাকি ক্রুরা। এসেক্স ডোবার নয় সপ্তাহ পার হয়ে গেছে ততদিনে। শেষপর্যন্ত নাবিকেরা বাধ্য হয়ে লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করতে শুরু করলেন পরবর্তী খাদ্য কে হবে। এ লটারির প্রথম শিকার হলেন ক্যাপ্টেন পোলার্ডের কাজিন ওয়েন কফিন।


সমুদ্রে ভাসার ৮৯ দিন পরে ১৮ ফেব্রুয়ারি চেজের নৌকার অবশিষ্ট তিন আরোহী দূরে একটি পাল দেখতে পেলেন। পাগলের মতো সেটির দিকে নৌকা চালালেন তারা। অবশেষে ইংরেজ জাহাজ 'ইন্ডিয়ান' তাদেরকে উদ্ধার করল।


ওদিকে ৩০০ মাইল দূরে পোলার্ডের নৌকায় শুধু ক্যাপ্টেন আর চার্লস রামসডেল নামক এক কিশোর নাবিক বেঁচে আছেন। তাদের কাছে খাবার বলতে কেবল অন্য নাবিকদের হাড়ের টুকরা। খিদের চোটে মরিয়া হয়ে সেগুলো ভেঙেও আহার করলেন তারা। চেজের নৌকা উদ্ধার পাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পরে মার্কিন জাহাজ 'ডফিন' পোলার্ডদের নৌকাটি সমুদ্রে দেখতে পায়। শোনা যায়, উদ্ধার হওয়ার সময় পোলার্ড আর রামসডেলের মুখে কোনো আনন্দ দেখা যায়নি। নৌকা ছেড়ে জাহাজে ওঠার সময় তারা অবশিষ্ট হাড়গুলো নিয়ে আসেন। জাহাজে ওঠার পর তাদেরকে ওসব হাড় চুষতে দেখা যায় — এমনকি সেগুলো ফেলে দিতেও মারাত্মক অনীহা দেখিয়েছিলেন তারা।


এসেক্সের মোট পাঁচজন বেঁচে যাওয়া ক্রু চিলির ভ্যালপারাসিওতে মিলিত হন। এরপর সুস্থ হয়ে তারা নানটাকেটের দিকে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে অন্য ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে ডিনার টেবিলে পুরো ঘটনা খুলে বলেছিলেন পোলার্ড। তার সেসব কথা লিখে রেখেছিলেন একজন ক্যাপ্টেন।


কয়েক বছর পরে তাদের তৃতীয় নৌকাটি প্রশান্ত মহাসাগরের ডুসি আইল্যান্ডে পাওয়া যায়। নাবিকদের কঙ্কালগুলো নৌকার ভেতরেই ছিল। তবে যে তিন নাবিক হ্যান্ডারসন দ্বীপে রয়ে গিয়েছিলেন, অলৌকিকভাবে তারা প্রায় চার মাস ওখানে টিকে ছিলেন শেলফিশ আর পাখির ডিম খেয়ে। অবশেষে এক অস্ট্রেলিয়ান জাহাজ তাদেরকে উদ্ধার করে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.