প্রাণীদের মধ্যে ‘কুমারী জন্মের’ জেনেটিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা



 ODD বাংলা ডেস্ক: জীববিজ্ঞানী অ্যালেক্সিস স্পেরলিং জীবের বিকাশ নিয়ে গবেষণা করেন। পিএইচডি করার সময় একদিন গবেষণাগারে অদ্ভুত এক কাণ্ড লক্ষ করেন, যা তাকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে এরপর থেকেই। তিনি দেখেন, একটি প্রেয়িং ম্যান্টিস' পতঙ্গ পুংলিঙ্গের সাথে জৈবিক মিলন ছাড়াই সন্তান জন্ম দিয়েছে।       


মানুষসহ স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীদের মধ্যে কখনো এমনটি দেখা যায়নি, কিন্তু বাদবাকি প্রাণীজগতের মধ্যে কিছু প্রজাতি এভাবে জন্মদানে সক্ষম। চিড়িয়াখানায় বন্দি ও দীর্ঘদিন পুরুষ সঙ্গীর সাথে মিলিত হওয়া থেকে বঞ্চিত – কিছু প্রাণীর মধ্যেও এ ধরনের ঘটনা দেখা গেছে।     


২০১৫ সালে একদল বিজ্ঞানী প্রথম প্রাকৃতিক পরিবেশে যৌন-মিলনহীন জন্মদানের ঘটনা লক্ষ করেন স্মলটুথ মাছেদের মধ্যে। প্রজাতিটি ছিল বিপন্ন হওয়ার পর্যায়ে। আর বছর দুই আগে সান দিয়াগো চিড়িয়াখানায় আরেকটি বিপন্ন প্রজাতি ক্যালিফোর্নিয়া কনডর প্রজাতির একটি স্ত্রী শকুন যৌনমিলন ছাড়াই ডিম দেয়। এক্ষেত্রে অবশ্য পুরুষ সঙ্গীর সাথে মিলনের সুযোগ থাকার পরও শকুনটি তা করেনি।


মিলন ছাড়া সন্তান উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম 'পার্থিওজেনেসিস' বা কুমারী জন্ম (ভার্জিন বার্থ)। স্ত্রী প্রাণী যদি চারপাশের পরিবেশের সাথে উত্তমরূপে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উপযোগী হয় – সেক্ষেত্রে এই সক্ষমতা কোনো প্রজাতির জন্য একটি বড় সুবিধা হতে পারে।


এভাবে জন্ম নেওয়া সন্তানরা হয় তাদের মায়েরই ক্লোন, বা জেনেটিকভাবে হুবুহু একই। ফলে তাদেরও সন্তান জন্মদানে পুরুষসঙ্গীর প্রয়োজন হয় না। বরং পরের প্রজন্মের সন্তান উৎপন্ন করার ক্ষমতা এভাবে দ্বিগুণ বেড়ে যায়।


কিন্তু, কীভাবে ও কেন পার্থিওজেনেসিস হয়, এবং কেন স্তন্যপায়ীদের মধ্যে তা ঘটে না – তা আজো রহস্যাবৃত।  


এই রহস্য উন্মোচনেই কাজ করছেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব বিবর্তন-বিজ্ঞানী স্পেরলিং। জিন পরিবর্তন বা মডিফাই করার মাধ্যমে পার্থেওজেনেসিসে সক্ষম একটি প্রাণী তৈরি করে – এই অজানার কিছুটা উন্মোচন করেছেন তিনি ও তার সহকর্মীরা।   


বিজ্ঞানীরা পার্থেওজেনেসিসে কীভাবে হয়, তা জানতে প্রথমে ফ্রুট ফ্লাইয়ের দুটি প্রজাতিকে বাচাই করেন। এরমধ্যে একটি পার্থেওজেনেসিসে সক্ষম। এর সাথে অন্য প্রজাতিটির প্রজননগত পার্থক্য সৃষ্টিকারী তিনটি জিন শনাক্ত করেন তারা। এরপর গবেষণার জন্য নির্ধারিত প্রজাতিটির মধ্যে ওই জিনগুলোর পরিবর্তন ঘটান।


এভাবে ফ্রুট ফ্লাই (বৈজ্ঞানিক নাম Drosophila melanogaster) পার্থিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় পরে সন্তান জন্মও দিয়েছে। এই প্রথম জিন-পরিবর্তনের মাধ্যমে যা কৃত্রিমভাবে করা গেছে প্রাণীদেহে।


পুরুষসঙ্গীহীন অবস্থায় ৪০ দিন – যা প্রজাতিটির অর্ধেক আয়ুষ্কাল – রাখা হয় ফ্রুট ফ্লাইকে। দেখা যায়, জেনেটিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেরাই সন্তান জন্ম দিচ্ছে।


ফ্রুট ফ্লাইয়ের এ প্রজাতি জৈবিক মিলনের মাধ্যমেই গর্ভবতী হয়ে ডিম দেয়, যা পরে লার্ভায় পরিণত হয়। কিন্তু, এবারই প্রথম তারা জৈবিক মিলন ছাড়া সন্তান উৎপন্ন করেছে।   


অভূতপূর্ব এই আবিষ্কারের তথ্য সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক জার্নাল 'কারেন্ট বায়োলজি'-তে প্রকাশিত হয়েছে। স্পেরলিং নিবন্ধটির প্রধান লেখক। তিনি জানান, 'মাছির সন্তানগুলো সম্পূর্ণ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তারা যেমন পার্থেওজেনেসিসসে সক্ষম, তেমনি জৈবিক মিলনের মাধ্যমেও জন্মদান করতে পারবে।"


প্রাণীরাজ্যের রহস্যময় প্রক্রিয়া পার্থেওজেনেসিস সম্পর্কে বিজ্ঞান বেশ কমই জানে। এ প্রক্রিয়ায় সঙ্গীর সাথে মিলন ছাড়াই স্ত্রী প্রাণীর গর্ভাশয়ে ভ্রুণ গঠন শুরু হয়। এক্ষেত্রে ডিম্বাশয় নিষিক্তে পুরুষ শুক্রাণুর প্রয়োজন হয় না। পার্থিওজেনেসিস এর মাধ্যমে সবসময় স্ত্রীলিঙ্গের সন্তানই জন্ম নেয়।


ইতঃপূর্বে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে যৌনমিলনহীন সন্তান উৎপন্ন করার সক্ষমতা তৈরির চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, তা ব্যর্থই হয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে মিলনের ইঙ্গিতবহ ১৫০টি জিনের সরাসরি অংশগ্রহণ দরকার হয় গর্ভধারণে। নাহলে ডিম্বানু নিষিক্তের প্রক্রিয়াটি ঘটে না। অর্থাৎ, পুরুষ ও স্ত্রী প্রাণীর মিলন ঘটলেই কেবল ডিম্বানু নিষিক্তের জন্য সক্রিয় হয়।  


ইঁদুরের দেহে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা এই বাধা দূর করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা করা যায়নি। জেনেটিক পরবর্তন আনার পরও, তাদের ডিম্বানুকে কৃত্রিমভাবে শুক্রানু দিয়ে নিষিক্ত করতে হয় বিজ্ঞানীদের।    


বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানুষ ও প্রাইমেট (নর-বানর) প্রজাতির মধ্যে পার্থেওজেনেসিসের বাধাগুলো আরও জটিল। ফলে তাদের দেহকে এই প্রক্রিয়ায় গর্ভধারণের উপযোগী করার কাজটি বেশ কঠিন।


সাম্প্রতিক গবেষণার গুরুত্ব কিন্তু অন্যত্র, বা বলতে গেলে কৃষিখাতে। এজন্যই ফ্রুট ফ্লাই মাছিকে বেছে নেওয়া হয়।


আধুনিক কৃষিতে নানান কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ছে দিনকে দিন। এতে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বালাইনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে উঠছে। পার্থেওজেনেসিসের মাধ্যমেও ডিম দিয়ে জন্মদানের সক্ষমতা বাড়ছে তাদের। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে পতঙ্গের মিলনহীন জন্মদানের সক্ষমতাকে ভালোভাবে জানাটা জরুরি।    


স্পেরলিং বলেন, 'ফসলে আক্রমণকারী পতঙ্গের অনেক প্রজাতিই এখন পার্থেওজেনিক। কীটনাশক ব্যবহার করায় এক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা রয়েছে অবশ্যই। তাছাড়া, একইরকম জিনের শস্য আবাদ করার ফলেও পতঙ্গের জন্য এই অভিযোজন আয়ত্ত করা সহজ হচ্ছে।'

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.