১৮৮৯ সালে রানি মার্গেরিতার নামে নামকরণ পিজ্জার যেভাবে বিশ্বজয়!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: গেল সপ্তাহে প্রাচীন রোমান নগরী পম্পেইয়ের একটি বাড়ির দেয়ালে আবিষ্কৃত ফ্রেসকো (দেয়ালের ভেজা প্লাস্টারের ওপর আকা চিত্রকর্ম) রন্ধনশিল্পের ইতিহাসে নতুন এক টুইস্ট যোগ করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, প্রায় ২০০০ বছর আগে মাউন্ট ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীর এই চিত্রকর্ম আসলে 'বিখ্যাত ইতালিয়ান পিজ্জার পূর্বসূরিকে' নির্দেশ করে।


অনেকেই জানেন, ১৮ শতকে ইতালির নেপলস থেকে মাত্র ১৪ মাইল দূরে পিজ্জা নামক খাবারটি ক্রমে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। সেসময় এই শহরের দরিদ্ররা সস্তা ও চটজলদি খাওয়ার একটি আইটেম বের করার উদ্যোগ নেয়।


ফ্ল্যাটব্রেড বা সমান করে বেলে নেওয়া কিছুটা পুরু রুটির উপর বিভিন্ন টপিংস দেওয়া খাবারগুলো পথের ধারে বিক্রি হতো। তখনকার সমসাময়িক ইতালিয়ান লেখকরা এই খাবারটিকে 'জঘন্য' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন!


কিন্তু ১৮৮৯ সালে যখন ইতালির রানী মার্গেরিতা তার স্বামী, রাজা প্রথম উমবের্তোকে নিয়ে নেপলস পরিদর্শনে আসেন এবং এক স্লাইস পিজ্জা চেখে দেখেন, তখন এই খাবারটি যেন এক রাজকীয় মাত্রা পায়। অথচ সেদিন রানীর খাওয়া পিজ্জাটিতে টপিংস হিসেবে ছিল শুধুমাত্র সফট হোয়াইট চিজ, টমেটো এবং পুদিনা পাতা। 


এরপর রানীর সম্মানার্থে তার নামেই এই পিজ্জার নামকরণ করা হয়। মার্গেরিতা পিজ্জার 'মার্গেরিতা' যদিও ইতালিয়ান উচ্চারণ, কোনো কোনো স্থানে এটি মার্গারিটা পিজ্জা নামেও পরিচিত।  


তবে ইতালি নয়, পিজ্জার বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা শুরু হয় আমেরিকাতে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন অভিবাসী নেপোলিটানরা (নেপলসের স্থানীয়দের বলা হয়) তাদের রন্ধনশৈলী জ্ঞান আমেরিকাতে বয়ে আনে এবং চর্চা শুরু করে তখনই এর জনপ্রিয়তার শুরু।



নিউইয়র্কের পিজ্জা আউটলেট লোম্বারদি'স চালু হয় ১৯০৫ সালে। আমেরিকার একদম প্রথম দিকের পিজ্জেরিয়া (যেখানে পিজ্জা তৈরি ও বিক্রি হয়) হিসেবে এটির সুনাম রয়েছে। অন্যদিকে, ডিপ ডিশ ভার্সনের প্রথম প্রচলন ঘটে ১৯৪০'র দশকে শিকাগোতে।


সর্বপ্রথম ইতালিয়ান পিজ্জেরিয়া 'দা পিয়েত্রো' প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮০ সালে নেপলসে। সেই আউটলেটটি পরবর্তীতে 'পিজ্জেরিয়া ব্রান্দি' নামে পরিচিত হয়। লেখক জন মারিয়ানির ভাষ্যমতে, এই দোকানের মালিক রাফায়েল এসপোজিতোই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি রানী মার্গারিটার নেপলস সফরের সময় তাকে পিজ্জা বানিয়ে খাইয়েছিলেন।


লেখক মারিয়ানি তার বই 'হাউ ইতালিয়ান ফুড কনকোয়ার্ড দ্য ওয়ার্ল্ড' নামক বইয়ে লিখেছেন: 'ইতালির নতুন পতাকার রঙ এর সাথে সাদৃশ্য রেখে সাদা, সবুজ ও লাল রঙ এর উপাদানে সজ্জিত, টপিংস দেওয়া পিজ্জাটিকে রানী তার প্রিয় আইটেম বলে আখ্যা দেন এবং হঠাৎ করেই এটি নেপলসে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।'


কিন্তু তখনো পিজ্জা শুধুমাত্র 'নেপলিটান সৃষ্টি' হিসেবেই ছিল। ইতালির অন্যান্য অংশে এটি অপরিচিতই থেকে যায়। এমনকি ১৯১৮ সালের আগপর্যন্ত 'পিজ্জেরিয়া' শব্দটি ইতালির কোনো সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা নিবন্ধের প্রিন্ট সংস্করণে উঠে আসেনি।


ম্যানহাটনের স্পিং স্ট্রিটে জেন্নারো লোম্বারদি'স আউটলেট যাত্রা শুরু করে একটি মুদি দোকান হিসেবে, কিন্তু পরে তারা অভিবাসী ইতালিয়ান- যারা বাড়িতে পিজ্জা তৈরিতে অপারগ ছিল- তাদের কাছে পিজ্জাও বিক্রি করতে শুরু করে। ১৯৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ ইতালিয়ান অধ্যুষিত এলাকায়ই পিজ্জেরিয়া গড়ে ওঠে, যেগুলোতে নানা বৈচিত্র্যময় টপিংস সহযোগে পিজ্জা তৈরি করা হতো।


মূলত, যুক্তরাষ্ট্রে পিজ্জার জনপ্রিয়তা থেকেই ইতালিতে নেপলসের বাইরে পিজ্জা সুপরিচিত হয়ে ওঠে।


লেখক মারিয়ানি লিখেছেন, 'ব্লু জিনস এবং রক অ্যান্ড রোল এর মতো পিজ্জাকেও ইতালিয়ানরাসহ বাকি বিশ্ব আপন করে নেয় কারণ এগুলো ছিল 'আমেরিকান'।'



প্রাথমিকভাবে পিজ্জেরিয়া উনো'র আইকে সিওয়েল এবং রিক রিকার্ডো ১৯৪৩ সালে শিকাগো স্টাইলের ডিপ-ডিপ ডিশ পিজ্জা তৈরি করেন যা কালো লোহার স্কিলেটে (লম্বা হাতলযুক্ত পাত্র) রান্না করা হতো। এই পিজ্জার ডো বেজ ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি পুরু এবং ঐতিহ্যবাহী পিজ্জার তুলনায় এতে আরও অনেক বেশি উপাদান ব্যবহার করা হতো। কিন্তু দেখা গেল, আমেরিকানদের মধ্যে এটাই ব্যাপক হিট হয়ে গেল।


পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে পিজ্জা টেকঅ্যাওয়ের জন্য বিশেষ কার্ডবোর্ডের বাক্স ব্যবহার করার আইডিয়াও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং ষাটের দশকের শেষভাগে ফ্রোজেন পিজ্জা হয়ে উঠলো অনেকের কাছে নির্ভরতার আরেক নাম।


রোজ এবং জিম তোতিনো মিলে তোতিনো'স নামক পিজ্জেরিয়া প্রতিষ্ঠা করেন যা এখনও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রোজেন পিজ্জা ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড।


অন্যদিকে, আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপেও প্রভাব বিস্তার করে চলছিল পিজ্জা। লন্ডনের দ্য ওলিভেল্লি রেস্টুরেন্ট চালু হয় ১৯৩৪ সালে। রেস্টুরেন্ট প্রাঙ্গণে পাওয়া ডকুমেন্ট থেকে জানা যায় কিভাবে পিজ্জা আবিষ্কারের একদম শুরুর দিকে মার্গেরিতা পিজ্জা তৈরির একটি রেসিপি তৈরি করা হয়েছিল।


১৯৬৫ সালে ওয়েস্ট লন্ডনের ওডু স্ট্রিটে জনপ্রিয় পিজ্জা ব্র্যান্ড পিজ্জাএক্সপ্রেস এর প্রথম আউটলেটটি চালু করেছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা পিটার বোয়জো।


বোয়জো নেপলস থেকে একটি পিজ্জা ওভেন আমদানি করেন এবং ওয়াডুর স্ট্রিটে দুই শিলিং এর বিনিময়ে এক স্লাইস পিজ্জা বিক্রি করতেন। পিজ্জার ডো তৈরির জন্য তিনি এক প্রবীণ সিসিলিয়ানকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।


১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পিজ্জাএক্সপ্রেস জ্যাজ ক্লাবের সহায়তায় এই ব্র্যান্ড আরও শক্তিশালী হতে থাকে। এলা ফিটজেরাল্ড এবং পরবর্তীতে অ্যামি ওয়াইনহাউজের মতো শিল্পীরা এই জ্যাজ ক্লাবে পারফর্ম করেছেন। ধীরে ধীরে এই ব্র্যান্ড ব্রিটেন এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।


এদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী পিজ্জা ব্র্যান্ড পিজ্জা হাট প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় নর্থ লন্ডনে, ১৯৭৩ সালে এবং ডমিনো'জ এর প্রথম আউটলেট চালু হয় লুটনে ১৯৮৫ সালে। দুটি ব্র্যান্ডেরই যুক্তরাষ্ট্রে আবির্ভাব ঘটে; প্রথমটি চালু হয় কানসাসে ১৯৫৮ সালে এবং টম ও জেমস মোনাগান ১৯৬০ সালে মিশিগানে চালু করেন ডমিনিক'স।


গেল সপ্তাহে পম্পেইয়ে খননকাজের সময় অর্ধেক ধসে পড়া একটি দেয়ালে আবিষ্কৃত হয় ফ্রেসকোটি। এই চিত্রকর্মে দেখা যায়, একটি সিলভারের প্লেটে গোলাকার ফ্ল্যাটব্রেড এবং সেইসঙ্গে তাজা ও শুকনো ফলমূল, যেমন- ডালিম, খেজুর সাজিয়ে রাখা হয়েছে এবং একটি পানপাত্রে রেড ওয়াইন রাখা হয়েছে।


ধারণা করা হচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে প্রথম শতকের একটি গ্রিক রীতি অনুযায়ী অতিথিদেরকে 'আতিথেয়তামূলক উপহার' দেওয়া ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ওই ফ্রেসকোতে। ভার্জিল ও ফিলোস্ট্রেটাসহ সাম্রাজ্যবাদী রোমান যুগের লেখকদের লেখায় এই গ্রিক রীতির কথা উঠে এসেছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.