৪০ বছর ধরে নিজেই নিজেকে পোস্টকার্ড পাঠিয়ে আসছেন এই ভ্রমণপ্রেমী নারী!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ডেবরা ডোলান যখন প্রথমবারের মতো সলো ট্রিপে গিয়েছিলেন তখন তার বয়স ছিল ২১ বছর এবং তখনই তিনি প্রথম নিজেকে একটি পোস্টকার্ড পাঠান। অনেকেই হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন যে, নিজেই আবার নিজেকে পোস্টকার্ড পাঠানো যায় নাকি?


সালটা ছিল ১৯৭৯; সেন্ট্রাল কানাডায় বেড়ে ওঠা ডোলান সেবছর ভ্যাঙ্কুয়েভারে ঘুরতে গিয়েছিলেন। এই নগরীর সৌন্দর্য্য ও প্রাণবন্ত ভাব দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন।  তার ভাষায়, 'ওখানেই আমি প্রথম এত সুন্দর পাহাড়-পর্বতমালা ও সমুদ্র দেখি।'


ভ্যাঙ্কুয়েভার ভ্রমণের এই আনন্দের মুহূর্ত কোনো না কোনোভাবে স্মৃতির পাতায় বন্দী করতে চেয়েছিলেন ডোলান। শুরুতে ডায়েরি লেখার কথা মাথায় আসলেও, তিনি এই ভ্রমণে এতটাই মজে ছিলেন যে ডায়েরি লেখার ফুরসতই পাননি।


ডোলান বলেন, "আমার মনে হয়েছিল, আমার তো নিজের জার্নালে লেখার সময়ই মিলবে না, আর আমি ক্যামেরাও নিয়ে যাইনি। তাই যখন আমি হুইস্টার বা ভ্যাঙ্গুয়েভার আইল্যান্ডের মতো দর্শনীয় স্থানগুলোতে গেলাম, আমার মাথায় আসলো যে আমি নিজেই নিজেকে পোস্টকার্ড পাঠাবো।"


প্রতিটি কার্ডের অপর পাশে ডোলান ছোট্ট এক প্যারা লিখে দিতেন বা ওই ভ্রমণ সম্পর্কে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতেন। তারপর এগুলো নিজের বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতেন আর সবশেষে একটা লাভ চিহ্ন এঁকে দিতেন লেখার শেষে।


১০ দিন পর যখন ডোলান বাড়ি ফিরে এলেন, দেখলেন তার নিজের পাঠানো একগাদা পোস্টকার্ড জমেছে তার কাছে। এগুলো হাতে পেয়ে এক অন্যরকম আনন্দ অনুভব করলেন ডোলান।


এর আগে নিজের অনেক কলমি-বন্ধু বা পেন-ফ্রেন্ডকে প্রচুর চিঠি লিখেছেন ডোলান। কিন্তু নিজেই নিজেকে লেখার অনুভূতি যেন সবচেয়ে আলাদা- যখন তিনি জানেন যে এই লেখা-ছবিগুলোর অর্থ শুধুই তার চোখে ধরা পড়বে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই পোস্টকার্ডগুলোই একসময় তার কাছে ফেলে আসা সময়ের অমূল্য দলিল হয়ে দাঁড়াবে।


ভ্যাঙ্কুয়েভার ট্রিপ ডোলানের জন্য খুবই অর্থবহ ছিল এবং এটা তার মধ্যে ভ্রমণের প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়িয়ে তোলে। ছোটবেলায় তিনি কানাডায় ক্যাম্পিং ট্রিপে যেতেন তার বাবা-মায়ের সাথে, কিন্তু তার পরিবার নিজ প্রদেশের বাইরে তেমন ভ্রমণ করেনি, তাই ডোলানকে একা ঘুরতেও দেওয়া হতো না।


"কিন্তু ভ্যাঙ্কুয়েভার থেকে ফিরে আসার পর আমি উপলব্ধি করলাম ভ্রমণ এত সহজ! আর একা ভ্রমণ করা আরও সহজ। আমাকে এটা নিয়ে নার্ভাস হবার কোনো কারণ নেই", বলেন ডোলান।


কর্পোরেট জীবনে এগিয়ে যাওয়ার যে তাড়না তার মধ্যে ছিল তা তিনি দূরে সরিয়ে দিলেন এবং সারা বিশ্ব ভ্রমণ করাই তার মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠল।



তার ভাষ্যে, "আমার নিজেকে খুব সাহসী মনে হচ্ছিল। আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা হতে চেয়েছিলাম। এরপরে আমি কানাডাজুড়ে হিচ-হাইক (যানবাহনে ফ্রি লিফট নিয়ে ভ্রমণ) এর মাধ্যমে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করলাম।"


এরপরে কানাডা থেকে ডোলান পৌঁছে যান অস্ট্রেলিয়া। সেখানে কয়েক মাস ভ্রমণ করেন। এরপরে ডোলান প্রায় টানা তিন বছর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন।


আশির দশকের শুরুর দিকে এসব অ্যাডভেঞ্চারের সময় বিশের কোঠায় থাকা ডোলান ট্রাভেল জার্নালও রেখেছেন, কিন্তু একইসাথে তিনি নিজেকে পোস্টকার্ড পাঠানোও বন্ধ করেননি। তিনি এই কার্ডগুলো তার বাবা-মায়ের বাড়ির ঠিকানায় পোস্ট করতেন। কখনো কখনো বদ্ধ খামে পুরে দিতেন যাতে করে তা গোপনীয় রাখা যায়। 


এরপরে কেটে গেছে চল্লিশ বছর… এবং ডোলান এখনও একজন পর্যটক, এখনও তিনি পোস্টকার্ড লিখতে ঠিক আগের মতোই আগ্রহী। বিগত কয়েক দশকে তিনি নিজেকে কয়েকশো পোস্টকার্ড লিখেছেন। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সবগুলোই সঠিক ঠিকানায় এসে পৌঁছেছে; শুধু কখনো কখনো হয়তো বছরখানিক পিছিয়ে গেছে… কিন্তু ডোলান প্রতিটি পোস্টকার্ড সযত্নে রেখে দিয়েছেন তার ভ্রমণস্মৃতি হিসেবে। 


ডোলান বলেন, "এই কার্ডগুলো আমার সম্পর্কে জানায়… শুধুমাত্র আমি কোন কোন জায়গায় গিয়েছি তা-ই নয়, ওই দিনটিতে আমি কেমন ছিলাম সে সম্পর্কেও। ডোলান জানান, এই পোস্টকার্ডগুলোর দিকে তাকালে তার নিজ প্রচেষ্টা কত দীর্ঘমেয়াদি ছিল তা বুঝতে পারেন এবং যত অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তা থেকে শিক্ষালাভের অনুপ্রেরণা দেয়।


"একজন তরুণ হিসেবে ভ্রমণকে নিজের জীবনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এটাকেই প্রধানত মূল্যায়ন করেছি। ভ্রমণের মাধ্যমে আমি সবচেয়ে স্বাধীনতা অনুভব করতাম, মুক্ত অনুভব করতাম। ভ্রমণের সময়ই আমি নিজ সত্ত্বাকে সবচেয়ে বেশি আপন করে নিতে পারতাম। আর পোস্টকার্ডগুলোতে এই বিষয়গুলোই উঠে এসেছে", বলেন তিনি। 


পোস্টকার্ডে উঠে আসা জীবন


বর্তমানে ডোলানের বয়স ৬৪ বছর এবং তিনি ভ্যাঙ্কুয়েভারে বসবাস করেন, যে শহরে শুরু হয়েছিল তার সলো ট্রিপ। তিনি ভ্রমণের পয়সা জমানোর জন্য প্রশাসনিক খাতে কাজ করেছেন।


একসময় ডোলানের শত শত পোস্টকার্ড তার ঘরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতো। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে ভ্রমণের গতি কমে আসায় এবং সম্প্রতি তিনি অত বেশি ভ্রমণ করতে পারেননা বলে সবগুলো পোস্টকার্ড একত্রে গুছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।


"তাই আমি ইচ্ছা করে জার্নাল থেকে সেগুলো তুলে নেই, ড্রয়ার থেকে বের করে আনি, সব এক জায়গায় রাখার জন্য। সবগুলো পোস্টকার্ড আবারও একসঙ্গে দেখতে পেরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি", বলেন ডোলান।  


ডোলানের ৪০ বছর পুরনো পোস্টকার্ডও এখনো টিকে আছে, হয়তো রং চটে গেছে, মলিন হয়ে গেছে কিছুটা। একটা জায়গা ভ্রমণ করে তখন কি অনুভূতি হয়েছিল তা এখন ডোলানের মনে না থাকলেও, পোস্টকার্ডে ঠিকই সেই আবেগের বর্ণনা আছে। বেশিরভাগ কার্ডেই ছিল ছবি, অন্যগুলোতে ইলাস্ট্রেশন বা বিখ্যাত কোনো চিত্রকর্মের রেপ্লিকা।



পোস্টকার্ড পাঠানোর মতোই পোস্টকার্ড বাছাই করেও একই রকম মজা পেতেন ডোলান। বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করতেন তিনি।


"যেমন, আমস্টারডামের রিকসমিউজিয়াম থেকে আপনি হয়তো বন্ধুকে পুরো আমস্টারডামের সার্বিক একটা চিত্র পাঠাবেন। কিন্তু নিজেকে আপনি পাঠাবেন শুধু সেই ছবিটা যেটা আপনাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে", বলেন ডোলান। 


নিজের পছন্দমাফিক মিউজিয়াম গিফট শপ বা স্বতন্ত্র দোকান থেকে পোস্টকার্ড কিনতেন ডোলান। যদিও যেখান থেকেই কিনেছেন, তিনি লক্ষ্য করেছেন যে সেগুলোতে বাস্তবের চাইতে একটা কাল্পনিক রূপ ফুটিয়ে তোলারই প্রয়াস থাকে।


ডোলান বলেন, "যে ছবি দেয়া হয় পোস্টকার্ডে সেটাই কি আপনি বাস্তবে দেখেন? না, ছবিটা অনেক ফটোশপড। আমি তো জায়গাটা এভাবে দেখিনি।" সে কারণেই মাঝেমাঝে ইলাস্ট্রেটেড কার্ড বেছে নিতেন তিনি।


কখনো কখনো ডোলানের আগে থেকেই নিজস্ব আইডিয়া থাকতো যে পোস্টকার্ডটা কেমন হবে। তখন তিনি আশেপাশের সব জায়গা চষে বেড়াতেন যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজের কল্পনামাফিক কার্ড পাচ্ছেন।


"আমি এক ক্রিসমাসের সময় ভিয়েনাতে ছিলাম। আমি চেয়েছিলাম এমন একটা পোস্টকার্ড পাঠাতে যেখানে দেখা যাবে বরফ পড়ছে, সুন্দর লণ্ঠন জ্বলছে অপেরা হাউজের বাইরে। ঠিক এমন একটা ছবিই আমি পাঠাতে চেয়েছিলাম।"


আবার কখনো কখনো মেঘ না চাইতেই জল- এর মতো অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যেতেন পোস্টকার্ড। ফিনল্যান্ডের হেলসিংকির একটি হোটেলের বাথরুমে তিনি পেয়েছিলেন লেখার ডেস্ক, কল আর ফ্রি স্যুভেনির পোস্টকার্ড!


ডোলান জানান, পোস্ট অফিসে যাওয়া-আসা, খাম কেনা, মেইলবক্স খোঁজা এই সবকিছু তাকে করতে হয়, তবুও তিনি কখনো 'চিট' করেননি, নিয়মমাফিক পোস্ট করে গিয়েছেন।


২০০৮ সালে কামিনো দে সান্তিয়াগোর পথে যাওয়ার সময় ডোলান একটি ব্যতিক্রমী কাজ করেন এবং তিনি পোস্টকার্ডের বদলে চিঠি পাঠান। কারণ তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে যাত্রাপথে পোস্টকার্ড কেনাটা সহজ নাও হতে পারে। ভ্রমণ শুরুর আগেই তিনি এয়ারমেইল পেপার, খাম ও স্ট্যাম্প কিনে নিয়েছিলেন; পরে যাত্রাপথে গ্রামের পোস্ট বক্স খুঁজে সেই চিঠি পোস্ট করেন। ডোলান জানান, সবগুলো কার্ডই এসেছিল, সিরিয়াল অনুযায়ী না হলেও, সবই এসেছিল।


সময়ের বিবর্তন ও অ্যাডভেঞ্চার


আজ পেছনে ফিরে তাকালে ডেবরা দোলান লক্ষ্য করেন যে কিভাবে তার হাতের লেখা বদলে গিয়েছে, কিভাবে তার পোস্টকার্ড লেখার ভাষা বদলে গেছে এবং কিভাবে তার ভ্রমণের অভ্যাসগুলো বদলেছে। আগে ব্যাকপ্যাক ট্যুর বেশি দিলেও এখন বয়সের কারণে তিনি কিছুটা বিলাসী উপায়ে ট্যুর পছন্দ করেন।


একসময় ডেবি নামে পরিচিত হলেও, এখন তিনি ডেবরা… তাই সে অনুযায়ী পোস্টকার্ডের ভাষাও বদলে গেছে। কিন্তু আজও তার পোস্টকার্ড লেখার অভ্যাস বদলায়নি এবং শেষে সাইন-অফ করতে গিয়ে লাভ চিহ্ন দেয়াও বদলায়নি।



"আমি সবসময় এই হার্ট চিহ্ন দিয়েই লেখা শেষ করতাম, সেটা কি আমার নিজের প্রতি ভালোবাসা নাকি এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার প্রতি, নাকি ওই মুহূর্তকে প্রশংসা করার জন্য ভালোবাসা তা আমি জানিনা", বলেন ডোলান।


পোস্টকার্ডে লেখা জায়গা ধরাতে তিনি একেক সময় একেক স্টাইলে লিখতেন। ২৫ বছর বয়সে ফিজি থেকে পাঠানো একটি পোস্টকার্ড নতুন করে আবার দেখতে পেরে হতবুদ্ধি হয়ে যান ডোলান। তারপর তিনি ট্রাভেল জার্নালের সাথে দিন-তারিখ মিলিয়ে দেখেন। এরপর তার মনে পড়ে যে সেদিনের ভ্রমণের কথা।


পোস্টকার্ডে নানা অনুভূতি-অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন ডোলান। হোস্টেলের আরেক বাসিন্দার উপর ক্রাশ থেকে শুরু করে লজ্জাজনক মুহূর্তের বর্ণনাও আছে। আবার কখনো একাকীত্ব অনুভব করলে সেই বেদনার কথাও লিখেছেন।  


মুহূর্তকে বন্দী করা


ডোলান সবসময়ই ক্যামেরা ছাড়া ভ্রমণ করেছেন। আর এখন তার হাতে স্মার্টফোন থাকলেও, ভ্রমণের সময় তা বাড়িতেই রেখে যান তিনি। তার সঙ্গীর কাছে সেলফোন থাকে, তারা হয়তো দুয়েকটা ছবিও তোলেন। কিন্তু ডোলানের কাছে পোস্টকার্ডই সবচেয়ে ভাল লাগে।


ডোলান মনে করেন, নিজের কাছে পাঠানো পোস্টকার্ডগুলো মুহূর্তের সাক্ষী এবং বর্তমানে বাস করার গুরুত্ব তুলে ধরে।


"ওই বিশেষ মুহূর্তগুলো শুধুই আপনার। আমরা সবাই হয়তো ভ্রমণে গেলে এরকম দেখে থাকি। সবাই হয়ত একই কাজ করি- আমরা রোমান কলোসিয়ামে যাই, কারণ সেখানে সবাই যায়। কিন্তু সেদিন আমি কি অভিজ্ঞতা লাভ করলাম তা অন্যের সাথে আমার মিলবে না। কিছু কিছু মুহুর্ত থাকবে একেবারেই একান্ত ব্যক্তিগত", বলেন ডেবরা।


"আমার মনে হয় পোস্টকার্ড আসলে সেই মুহূর্তটাই বন্দী করে। তারা হয়তো ওই ছবিটা ১০,০০০ পিস বিক্রি করেছে। কিন্তু এই পোস্টকার্ডের অপর পিঠে আমরা যে যা লিখেছি তা সম্পূর্ণ আলাদা- তা সে পোস্টকার্ড পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক না কেন", যোগ করেন তিনি। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.