ভারতবর্ষের বাইরে 'কারি'? সবচেয়ে পুরনো রেসিপি আবিষ্কার প্রত্নতাত্ত্বিকদের!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একদল প্রত্নতাত্ত্বিক এ অঞ্চলে 'কারি' রান্নায় ব্যবহৃত মশলা প্রক্রিয়াকরণের সবচেয়ে পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। পশ্চিমারা প্রায়ই যেটিকে 'কারি' বলে থাকে, বাংলায় তা 'তরকারি' হিসেবে পরিচিত। কমপক্ষে ১৮০০ বছর পুরনো মশলার অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করে প্রাচীনকালের বাণিজ্য সম্পর্কেও নতুন তথ্য পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।


অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ সিয়াও-চুন-হাং জনপ্রিয় সায়েন্স ম্যাগাজিন সায়েন্টিফিক আমেরিকান'কে বলেন, "এই গবেষণার আগে আমাদের কাছে প্রাচীনকালের মশলা বাণিজ্য সম্পর্কে শুধু ভারত, চীন এবং রোমের প্রাচীন নথিপত্র থেকে পাওয়া কিছু সূত্র ছিল। কিন্তু এই গবেষণা থেকেই প্রথম নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, মশলাগুলো বাণিজ্যিক পণ্য ছিল এবং প্রায় ২০০০ বছর আগে সমুদ্রপথে বিশ্ব বাণিজ্যের নেটওয়ার্কের মধ্যেই ছিল।"


ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের দ্বারা ইংরেজি 'কারি' শব্দটির উৎপত্তি; তারা দক্ষিণ এশিয়ার সস-মশলার মতো উপকরণে তৈরি যেকোনো পদকে 'কারি' বলতো। 'কারি' শব্দটি তামিল শব্দ 'kari' থেকে এসেছে বলেও মনে করা হয়- যার অর্থ সস।


২০১৭ সালে অ্যালেক্স ডেলানি বন অ্যাপেটি'তে লেখেন, 'কারি'কে অনেক দিক থেকেই একটা অর্থহীন পরিভাষা বলা চলে। উপনিবেশবাদীরা বিদেশি রন্ধনপ্রণালীতে যা দেখেছিল সেটাকে সহজভাবে বোঝানোর জন্য 'কারি' শব্দটাকে বেছে নিয়েছিল, তাদের মাধ্যমেই এটা বিশ্বের অনেক দেশে পরিচিত হয়ে উঠেছে।


নতুন গবেষণায় হাং এবং তার সহকর্মীরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের ওক ইও প্রত্নতাত্ত্বিক কমপ্লেক্স থেকে খনন করে আনা ৪০টি গ্রাইন্ডিং ও পাউন্ডিং টুলসে থাকা মাইক্রোস্কোপিক মশলার অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করেছেন। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের দলটি প্রথমে 'পেষনি' নামে পরিচিত এই পেষণযন্ত্রগুলোর কাজ বোঝার জন্যই চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাদের বিশ্লেষণে পাথরের তৈরি ১২টি টুলসে ৮ রকমের মশলার চিহ্ন পাওয়া যায়। এগুলো হলো: হলুদ, আদা, ফিঙ্গাররুট, স্যান্ড জিঞ্জার, গালাঙ্গাল (আদার মতো দেখতে এক ধরনের মশলা), লবঙ্গ, নাটমেগ (জায়ফল) ও দারচিনি।


এখান থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এই টুলসগুলো খাবার প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু প্রাচীন মশলা বাণিজ্য নিয়েও নতুন তথ্য উঠে এসেছে এই বিশ্লেষণে।


কিছু কিছু মশলা আছে যেগুলোর আদি উৎপাদনস্থল এই প্রত্নতাত্ত্বিক কমপ্লেক্স থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী অঞ্চলে। তার মানে ভারত মহাসাগর বা প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে এই মশলাগুলো এ অঞ্চলে এসে পৌঁছেছে। গবেষণার ফলাফল গত শুক্রবার সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।


রয়্যাল নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব সাউথইস্ট এশিয়ান অ্যান্ড ক্যারিবিয়ান স্টাডিজ-এর ভাষাবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ (যিনি নতুন গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন না) টম হুগারফোর্স্ট সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনকে বলেন, "তারা লবঙ্গের মতো মশলার কথা উল্লেখ করেছে, আর লবঙ্গ পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার সুনির্দিষ্ট একটি দ্বীপ অঞ্চল থেকে এসেছে। যখনই আপনি এটা ভিন্ন দেশে খুঁজে পাবেন, তখন ধরে নিতে হবে যে বাণিজ্যকভাবে এগুলো এসেছে, মূলত সমুদ্রপথে যোগাযোগের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।"সায়েন্স জার্নালে ফি জ্যাকবস লিখেছেন, ভিয়েতনামের ওক ইও-এ পূর্ববর্তী খননকাজ থেকে বোঝা যায় যে, শহরটি একসময় ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত প্রধান বাণিজ্যিক রুটের সংযোগস্থলে ছিল।


যেসব টুলস বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্য খনন করে তুলে আনা হয়েছে। কিছু কিছু আবার স্থানীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ আগেই সংগ্রহ করেছিল।


গবেষক দলটি নারকেল, ধানের অবশিষ্টাংশ এবং কিছু ব্যতিক্রমীভাবে সংরক্ষিত বীজের চিহ্নও খুঁজে পেয়েছে। ওক ইওতে খননের সময় পাওয়া একটি জায়ফলের বীজ ১২০ থেকে ২৪৮ খ্রিস্টাব্দের সময়কার। গবেষকরা এটিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে সবচেয়ে প্রাচীন জায়ফলের নমুনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এমনকি এত বছরের পুরনো হওয়া সত্ত্বেও বীজটির কাঠের-মিষ্টি গন্ধ রয়ে গেছে।


সাম্প্রতিক এই গবেষণার মাধ্যমে ভারতের বাইরে 'কারি' বা তরকারি নামক পদ রান্নার সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বলে কনভারসেশন-এ লিখেছেন গবেষকরা। অর্থাৎ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মশলায় রান্না রেসিপিগুলোর ইতিহাস আগে যত অনুমান করা হয়েছিল, এগুলো তার চেয়েও কয়েকশো বছর পুরনো। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.