নরখাদক বাঘ-শিকারি যেভাবে কিংবদন্তিতুল্য সংরক্ষণবিদ হয়ে উঠেছিলেন

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ১৮৭৫ সনে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সংযুক্ত প্রদেশে (বর্তমানের উত্তরাখণ্ড) জন্মেছিলেন এডওয়ার্ড জেমস করবেট। কাছের মানুষরা ডাকতেন জিম, যে নামেই পৃথিবীব্যাপী আজ তার পরিচিতি। অভিবাসী আইরিশ পিতামাতার ঘরে জন্মানো জিম ঘুরে ফিরেছেন আশেপাশের বনেবাদারে – কখনো কাঁধে বন্দুক, কখনোবা ক্যামেরা হাতে। বন্যপ্রাণীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও তাদের আচার-আচরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণে করবেটের জুড়ি মেলা ছিল ভার। কালক্রমে তাই দক্ষ শিকারি, এবং তারপর ইতিহাসখ্যাত এক সংরক্ষণবিদ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু কেমন কেটেছিল তার শৈশব; উপনিবেশিক শক্তির সাথে নাড়ির টান থাকার পরও – কীভাবেই বা হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশেরই এক সন্তান। করবেট নিজের গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে নিজ জীবন নিয়ে লিখে গেছেন বিস্তর। কিন্তু, তার বেড়ে ওঠার নেপথ্য দৃশ্যপট এক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে উঠে এসেছে ব্রিটিশ বায়োগ্রাফার – ডাফ হার্ট ডেভিসের লেখা 'হিরো অব কুমায়ুন: দ্য লাইফ অভ জিম করবেট' বইয়ে। আগামী ২৫ জুলাই করবেটের ১৪৮তম জন্মবার্ষিকি, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই জীবনী গ্রন্থটির নির্বাচিত এক অংশ টিবিএসের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো —

 


সালটা ১৮৪১, সে বছরই প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীরা এসে পৌঁছায় নৈনিতাল উপত্যকায়। এখানকার দারুণ আবহাওয়া ও অসাধারণ সৌন্দর্যের কথা বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ সেনা ও কর্মকর্তাদের মধ্যে। উজ্জ্বল লাল রঙের লোহার টিনে ছাওয়া বাড়িঘর তাই  দ্রুতই সেখানে গড়ে ওঠাও শুরু হয়। সব ছিল ঠিকঠাক। চারপাশের অনাবিল সৌন্দর্যকে নিয়ে নৈনিতাল 'গোড়া আদমিদের' এক সমৃদ্ধ ছোট্ট শহরেই রূপ নিচ্ছিল। কিন্তু, তারপরেই এলো ১৮৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। টানা দুই দিন ধরে চলে প্রবল বৃষ্টিপাত – প্রায় ৫০ ইঞ্চি ভারীবর্ষণে – নামে কাদার স্রোত। পাহাড়ের গায়ে গায়ে গড়ে ওঠা অনেক বাড়ি ও দোকান তাতে হয় ধসে পড়ে, নয়তো চাপা পড়ে যায়। একটি মন্দির, অ্যাসেম্বলি রুম ও হোটেলেরই একই পরিণতি হয়েছিল। এতে ৪৩ ইউরোপীয়-সহ মোট নিহত হয় ১৫১ জন।   


এত বড় দুর্যোগেও দমে যাননি বেঁচে যাওয়া মানুষজন। সবকিছু আবারো নতুন করে গড়ে তোলার কাজেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু, করবেট পরিবারের জন্য আরও দুঃসংবাদই অপেক্ষা করছিল। দুর্যোগের মাত্র মাস ছয়েক পর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ৫৮ বছর বয়সী ক্রিস্টোফার করবেট (জিমের বাবা)। এরমধ্যেই যে পাহাড়ে ভূমিধস নেমেছিল ঠিক তার উল্টোদিকের আয়াপার্তা পাহাড়ে একখণ্ড জমি কেনেন তার বিধবা স্ত্রী মেরি জেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সেখানেই চার বেডরুমের একটি বাড়ি নির্মাণ করান তিনি। করবেট পরিবারের গ্রীষ্মকালীন বাড়িটি সকলের কাছে 'গার্নে হাউস' নামেই ছিল পরিচিত। ততোদিনে নৈনিতাল পেয়েছে সংযুক্ত প্রদেশের ব্রিটিশ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানীর স্বীকৃতি। এপ্রিলেই সপরিবারে চলে আসতেন রাজ্যপাল। থাকতেন সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত। আয়াপার্তা পাহাড়ের চূড়ার এক কিনারে ছিল তার বাসভবন। আর পাহাড়ে নিচের সারিগুলোতে ছিল অন্যান্য অধিবাসীদের বাড়িঘর।  


এক কথায় ছোট্ট এক ইংল্যান্ড যেন নৈনিতাল। সংস্কৃতি আর কেতাদস্তুরও ছিল তেমনই। ইংরেজ আভিজাত্যের গর্ব ছিল সুস্পষ্ট। সমাজ ছিল বর্ণ-সচেতন (আজ যা বর্ণ-বিদ্বেষ) – ফলে নৈনিতাল হৃদের এক কিনারে অবস্থিত শহরের উপরের দিকে মল এলাকায় শুধু অভিজাত ও সুবিধাপ্রাপ্ত ভারতীয়রাই আসতে পারতো।    


জিম ছিলেন ১৬ ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম, বিশাল সংসার, পরিবারের আর্থিক সঙ্গতিও অন্য ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের মতো স্বচ্ছল নয়। তাদের শীতকালীন আবাস ছিল কালাঢুঙ্গি এলাকায়। যেখানে মাত্র দুটি শ্বেতাঙ্গ পরিবার থাকতো। শিশুকালে স্থানীয় এক আয়াই তার দেখাশোনা করেছেন। আর বড় হয়েছেন গ্রামের ছেলেদের সাথে। ফলে সহজেই কর্মস্থল ও পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরাঘুরির সময় স্থানীয় মানুষের সাথে অবলীলায় মিশে যেতে পারতেন। স্থানীয় টানের হিন্দিতেই কথা বলতে পারতেন। দুর্গম পাহাড়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে মানুষখেকো বাঘ ও চিতার পেছনে ধাওয়া করার সময় – স্থানীয় জীবনযাত্রা ও সংস্কার সম্পর্কে এই গভীর জ্ঞান ও উপলদ্ধি – জিম করবেটের জন্য এক অপরিহার্য সম্পদ হয়ে উঠেছিল। সেসময় যা ভারতের অন্য কোনো ইউরোপীয় শিকারির হয়তো ছিল না।


মায়ের দারুণ ভক্ত ছিলেন জিম। মেরি জেন ছিলেন বেশ শক্ত ধাঁচের মানুষ। মাত্র ছয় বা সাত বছর বয়সে গরুর গাড়ি ও নৌকায় করে পরিবারের সাথে কীভাবে কলকাতা থেকে পাঞ্জাবে পাড়ি দেন – যে যাত্রায় এক হাজারের বেশি মাইল পাড়ি দিতে কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল – তার খুঁটিনাটি শুনতে খুবই ভালোবাসতেন ছোট্ট জিম। মায়ের সম্পর্কে অবশ্য খুব বেশি লিখে যাননি তেমন করে। তবু এরমধ্যেই এক জায়গায় লিখেছেন, 'তার সাহস ছিল জোন অব আর্ক এবং নার্স ক্যাভেল- এ দুজনের মিলিত সাহসের সমান। কিন্তু, শান্ত, নম্র এক ঘুঘু পাখির মতোই স্থিরতা ছিল তার চরিত্রে'।   


মেরি জেনের বোন ম্যাগি (জিমের ম্যাগস খালা) অবশ্য আরও ভালোভাবে তার বর্ণনা দিয়েছেন:


"সে দেখতে ছিল খুবই ছোট, কিছুটা নাজুক গড়নের। চমৎকার গায়ের রঙ,  সুন্দরী নীল নয়না। একেবারেই স্বার্থপরতাহীন, যে সন্তানদের জন্য যেকোনো আত্মত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না, বা এনিয়ে কোনো গ্লানিতেও নেই তার। প্রায়ই আমার মনে হয়েছে ওর অনেক গুণ: বীরত্ব, সাহস, উদারতা ও দয়ালু স্বভাব আর কর্তব্যপরায়ণতা যেন জিম পেয়েছে। তাছাড়া, মা হিসেবে বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষাটাও ওরই হাতে। পৃথক একটি কক্ষে তাদের উচ্চারণ, গণিত ও সঙ্গীত শিক্ষা দিত মেরি জেন।"


ছোটবেলায় জিমের কণ্ঠস্বর ছিল সরু। কিন্তু, বেড়ে উঠতে উঠতে তার সুর আরও চড়া হয়। জন্মগত এই গুণটির দৌলতে অনায়সে নানান পাখি ও জীবজন্তুর ডাক অনুকরণ করতে পারতেন।


তার আন্টি ম্যাগিও কম গুণবতী ছিলেন না, তিনি পরবর্তীতে একজন গুণী সঙ্গীতশিল্পী হয়েছিলেন। নৈনিতালে শত শত ছাত্র তার কাছে পিয়ানো শিখেছে। কালাহুন্দিতে অসুস্থ মানুষদের সেবাআত্তিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন ম্যাগি – কি তাদের জাত, হিন্দু, মুসলমান না খৃষ্টান – তা নিয়ে ভেদাভেদ কখনো করেননি। সেকালে ম্যালেরিয়া ছিল মারাত্মক এক রোগ। কিন্তু, ম্যাগি দমবার পাত্রী ছিলেন না। হোক সে প্রবল কাশি, বলদের শিঙের গুঁতোয় গুরুতর আহত মানুষ বা ম্যালেরিয়া রোগী – দিনে কখনো কখনো এক ডজন রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতেন তিনি।  কুমায়ুনের পাহাড়ি জনপদে একজন উদ্যানবিদ হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ম্যাগি ভালোবাসতেন পাখিদের, বিশেষ করে গ্রামের আশেপাশের জঙ্গলে যে পাখিদের দেখা মিলতো তাদের।  


এই মানুষদের সাহচর্যে, তাদের দেখানো পথে বেড়ে ওঠাটা জিমের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়াই ছিল হয়তো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অবশ্য স্কুলেই হয়েছিল। ১০ বছরে নৈনিতালের তিনটি বিদ্যাপীঠে শিক্ষাগ্রহণ করেন জিম। এরমধ্যে ছিল ফিলান্ডার স্মিথ কলেজ, যদিও জিমের সবচেয়ে পছন্দের ছিল আমেরিকান মেথডিস্ট মিশন – যেখানকার শিক্ষকরা তাকে শোনাতেন জেমস ফেনিমোর কুপারের অ্যাডভেঞ্চার গল্প। 'দ্য লাস্ট অব দ্য মোহিকানস' উপন্যাস বার বার মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছেন জিম। আমেরিকান ধাঁচের সহজ এই রচনাশৈলী-ই হয়তো পরবর্তীকালে তাকে লেখালেখিতে উৎসাহ দিয়েছিল। জিম ছিলেন গল্পের বইয়ের পোকা। দিনরাত তাতেই ডুবে থাকতেন। স্কুলের আবাসিক হলে অনেক সময় অন্য ছাত্ররা জড়ো হতো তার বিছানার চারপাশে, আর জোরে জোরে গল্পপাঠ করে সবাইকে শোনাতেন জিম।


স্কুলজীবন নিয়ে অভিযোগ ছিল না তার, তবে বেশিরভাগ সময় বাইরে বাড়ে কাটাতেই পছন্দ করতেন। ছোট থেকেই শিকারের একটি সহজাত প্রবৃত্তি তার ভেতরে কাজ করতো। তা এতটাই প্রবল ছল যে একা একাই কালাঢুঙ্গির আশেপাশের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। বেশিরভাগ সময়েই যেতেন খালি পায়ে, যাতে চলাচলের সময় শব্দ কম হয়। এতে বিপদ বুঝলে গাছে চড়ারও ছিল সুবিধা – জুতা থাকলে যা করাটা বেশ কঠিনই। পরবর্তীকালে তিনি মন্তব্য করেছিলেন,  পাহাড়ের বনেবাদারে কৈশোরের এই দুরন্ত দস্যিপনা তাকে পাহাড়ি ছাগলের মতোই নিশ্চিন্তে চলাচলের দক্ষতা দিয়েছে।


জীবনের প্রথম অস্ত্র হিসেবে বড় ভাইয়ের টমের থেকে গুলতি পেয়েছিলেন জিম। নিউমোনিয়া থেকে সেরে উঠে জিম যখন ভীষণ ক্লান্ত, তখন তাকে চাঙ্গা করতেই গুলতিটি দেন টম। গুলতি দিয়ে নির্ভুল লক্ষ্যভেদে ওস্তাদ হয়ে ওঠেন জিম। ছোট ছোট অনেক পাখি তা দিয়ে শিকার করেন, যার কিছু তিনি চামড়া ছাড়িয়ে সংরক্ষণ করতেন অথবা দিতেন তার কাজিন স্টিফেন ডিজকে, যিনি তখন কুমায়ুনের পাখিদের নিয়ে একটি বই লিখছিলেন।


এরপরের অস্ত্র হিসেবে 'প্যালেট বো' (গুলতির গুলি/ ঢিল ছোড়ার এক ধরনের ধনুক) পান তিনি। গুলতির চেয়েও বহুগুণে শক্তিশালী এই অস্ত্র অবশ্য ততোটা নির্ভুল লক্ষ্যভেদে সক্ষম ছিল না, জিম এটা তেমন পছন্দও করতেন না। তারপরও এতে এতটাই দক্ষ হয়েছিলেন যে, সে সময়ে গুর্খা সেনাদলের এক হাবিলদারকে (সার্জেন্ট) প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেন– প্রায় ২০ মিটার দূরে রাখা ম্যাচবাক্সকে লক্ষ্যভেদ করে। উল্লেখ্য, সে সময় ইংরেজ সরকারের রাষ্ট্রীয় কোষাগার রক্ষার দায়িত্বে ছিল হাবিলদার সাহেবের সেনাদলটি। তারপরও এক সময় প্যালেট বো' আর সয়নি এক টিপে লক্ষ্যভেদে অভ্যস্ত জিমের কাছে। তাই নিজেই এবার বানিয়ে ফেলেন তীর-ধনুক। মজার বিষয় হলো ফেনিমুর কুপারের উপন্যাসগুলোয় রেড ইন্ডিয়ানদের ধনুকের যে বর্ণনা পড়েছিলেন- সেই ডিজাইনেই এটি বানান। কানাডার নির্জন সুদূর বিস্তৃত অরণ্যে কাঠুরে হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন জিম, তাই কুঠার হাতেও এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন যে এক কোপে দুই ভাগ করতে পারতেন দেশলাইয়ের কাঠি।


এই দক্ষতাগুলো নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন জিম। মানবিক গুণকেও আপন করে নেন। শাসক জাতির কুলীনতার মিথ্যে গৌরব ও মোহের পেছনে না ছুটে যিনি ভারতবর্ষকেই মাতৃভূমি সমান জ্ঞান করেছেন। তারপর বাকিটা শুধুই ইতিহাস। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.