থ্রেডস টুইটারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
ODD বাংলা ডেস্ক: অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে টুইটারের প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপ 'থ্রেডস' চালু করেছে মেটা। এর আগে বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রথম সাত ঘণ্টার মধ্যে ১০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী থ্রেডসে সাইন আপ করেছে বলে জানান কোম্পানির প্রধান মার্ক জাকারবার্গ। অনেকেই ধারণা করছেন, টুইটার ব্যবহারে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হওয়া অসন্তুষ্ট ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করবে থ্রেডস। কিন্তু মেটার এই অ্যাপটি আসলে কতটা কার্যকরী? সত্যিই কি টুইটারের জন্য একটি 'হুমকি' হয়ে দাঁড়াচ্ছে থ্রেডস? সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রযুক্তি সম্পাদক জো ক্লাইনম্যান এবং নর্থ আমেরিকা অঞ্চলের প্রযুক্তি সংবাদদাতা জেমস ক্লেটন জানিয়েছেন, এই অ্যাপটি প্রথম ব্যবহারের পর তাদের মধ্যে কি প্রভাব ফেলেছে।
জো ক্লাইনম্যান, প্রযুক্তি সম্পাদক
যে মুহূর্তে আমার ফোনটা বেজে উঠলো আমাকে জানান দিতে যে, অ্যাপ স্টোরে আমি 'মেটা থ্রেডস' নামক মেটার যেই নতুন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক অ্যাপটি প্রি-অর্ডার করেছিলাম সেটি ইনস্টল হয়ে গেছে, তখন যুক্তরাজ্যে ছিল মধ্যরাত।
সময়ের বিবেচনায় আমি ভাবিনি যে তখন এই অ্যাপ নিয়ে মানুষের মধ্যে সাড়া পড়ে যাবে। আমার একটা ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট তো আছেই, তাই মাত্র তিন ক্লিকেই নিজের প্রোফাইল তৈরি করে ফেললাম এবং ফটো-শেয়ারিং অ্যাপটিতে যাদেরকে ফলো করতাম, তাদের সবাইকে ফলো দিলাম।
হঠাৎ করেই আমার মনে হলো আমি একটা আড়ম্বরপূর্ণ-বড় পার্টিতে চলে এসেছি! কারণ দেখা গেল, প্রচুর মানুষ থ্রেডসে সাইন আপ করছে, নিজেদের প্রথম পোস্ট শেয়ার করছে, অন্যদের পোস্টে সাড়া দিচ্ছে এবং নতুন এই পরিবেশে নানা ধরনের কমেন্ট করছে।
এমনকি অ্যাপটিতে ঢোকার প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার কয়েক ডজন ফলোয়ার জুটে গেল এবং এই নিবন্ধ লেখার সময়ে আমার ফলোয়ার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক (টুইটারের আরেকটি বিকল্প, জ্যাক ডরসির প্রতিষ্ঠিত টেক্সট-ভিত্তিক নেটওয়ার্ক 'ব্লুস্কাই'-এ কিন্তু আমার ফলোয়ারের সংখ্যা এখনো তিনশোর কম। সেখানে আমার যোগদান করার কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেছে)।
আপনি যদি টুইটারের সাথে পরিচিত হয়ে থাকেন তাহলে থ্রেডস এর ডিজাইনও সাথেসাথেই চিনতে পারবেন। পোস্টে লাইক দেওয়ার জন্য হার্ট-শেপের প্রতীক থেকে শুরু করে রিপোস্ট করার চিহ্ন...সবকিছু একই রকম।
এর আগে ব্যক্তিগত ম্যাসেজ আদান-প্রদানের যথাযথ বৈশিষ্ট্য না থাকা, জনপ্রিয় কন্টেন্টকে তুলে ধরার জন্য হ্যাশট্যাগ বা ট্রেন্ড না থাকা এবং অ্যাকাউন্ট বা কোনো শব্দ মিউট করা ব্যাতীত টাইমলাইন কিউরেশনের (নিজের টাইমলাইনে কি কি আসবে তা বাছাই করা ও সাজানো) আর কোনো অপশন না থাকা নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল।
কিন্তু আমার মনে হয়, এখানে আমাদের বলা উচিত 'তবুও' থ্রেডস অফিশিয়ালি মাত্র কয়েক ঘণ্টা পুরনো একটি অ্যাপ (যদিও ২০১৯ সালে একটি সংস্করণ চালু হয়েও আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। হয়তো বিশ্ব তখন সেই অ্যাপটি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না, কিংবা টুইটারের কার্যকলাপে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল)।
টুইটারের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাইতে থ্রেডস এই কারণে আলাদা যে, এই প্ল্যাটফর্মে সুবিশাল, রেডিমেইড ইনস্টাগ্রাম কমিউনিটির তাৎক্ষণিক একীকরণ ঘটে। ফটো-শেয়ারিং অ্যাপ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করছে দুই বিলিয়ন মানুষ এবং এটাই তাদেরকে সহজে অন্য একটি প্ল্যাটফর্মে চলে আসার সুযোগ দিচ্ছে।
অর্থাৎ, এর ফলে নতুন প্ল্যাটফর্মটি তাৎক্ষণিকভাবে অন্য ইউজারদের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়- যা বিজ্ঞাপনদাতাদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করবে। আমার ধারণা, তারা একসময় এটার অর্থায়নও করবে। যদিও প্রথম এক বছর কোনো বিজ্ঞাপন থাকবে না।
জেমস ক্লেটন, নর্থ আমেরিকা অঞ্চলের প্রযুক্তি সংবাদদাতা
থ্রেডস ব্যবহার করার পর প্রথম অনুভূতি? মেটা কি সত্যিই এখানে সফল হবে? তারা যা করেছে এটা কি কোনো না কোনোভাবে এক ধরনের 'চুরি' নয়?
অ্যাপটি দেখতে প্রায় টুইটারের অনুরূপ। নিউজ ফিড, রিপোস্টিং, লাইক চিহ্ন... সব ক্ষেত্রেই অবিশ্বাস্য রকম মিল।
মার্ক জাকারবার্গ দাবি করেছেন যে, অ্যাপটি চালু হওয়ার প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কয়েক মিলিয়ন মানুষ এখানে সাইন আপ করেছেন। কিন্তু একজন টেক বস যখন বলবে এতজন লোক একটি প্ল্যাটফর্মে সাইন-আপ করেছে, সেই তথ্য নিয়ে সবসময়ই সংশয় প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু এখন সত্যিই মনে হচ্ছে যে অনেকেই এই প্ল্যাটফর্মে চলে এসেছেন।
এর আংশিক কারণ হচ্ছে আগে থেকে ইনস্টাগ্রামে যুক্ত থাকা। মেটা একদম শূন্য থেকে শুরু করেনি এই নতুন অ্যাপ বানানো। তারা তাদের ইনস্টাগ্রাম অ্যাপ, যেখানে ইতোমধ্যেই দুই বিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে, সেটির মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে। সেজন্যেই চালু হওয়ার সাথেসাথেই এটি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছে।
ব্লুস্কাই বা মাস্টোডন এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর এই বিলাসিতার সুযোগ ছিল না। তারা একেবারেই জিরো ইউজার দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে।
কিন্তু এটা 'ন্যায্য' না অন্যায্য, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন মিস্টার জাকারবার্গ। তিনি আগেও নিজের সফলতার জন্য অন্যান্য অ্যাপকে নকল করেছেন (রিলসও কিন্তু টিকটকেরই নকল) এবং এখনো খুশিমনে তা করে চলেছেন।
তারকাদের ক্ষমতা অনুধাবন করে জাকারবার্গ ইনস্টাগ্রামেও বিখ্যাত তারকাদের নিয়ে এসেছিলেন এবং থ্রেডসেও এদের কয়েকজনকে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন, শাকিরা ও গর্ডন র্যা মসের মতো তারকারা এখানে শামিল হয়েছেন।
নতুন অ্যাপটিকে নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে চর্চা দেখে নিশ্চয়ই ভীষণ আনন্দ ও উত্তেজনা বোধ করছেন মার্ক জাকারবার্গ। যখন আপনি সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে কথা বলছেন, তখন নেটওয়ার্ক ইফেক্টই মূখ্য বিষয়। যত বেশি মানুষ এই অ্যাপ ব্যবহার করবে, অ্যাপটি ততই ভালো হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক ইফেক্ট এক ধরনের 'টিপিং পয়েন্ট' (এমন একটি পর্যায় যখন সামান্য পরিবর্তন বা ছোটখাট ঘটনাও একটি বড় পরিবর্তন আনার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে) সৃষ্টি করে। যখন আপনার অনেক বন্ধুবান্ধব বা যাদের সাথে আপনি যোগাযোগ রাখতে চান, তারা একটি নতুন প্ল্যাটফর্মকে বেছে নেয়, তখন আপনাকেও শেষ পর্যন্ত ঐ প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে হয়।
একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নেটওয়ার্ক ইফেক্ট তৈরি করা খুবই কঠিন। কিন্তু যখন এটা কাজ করে, তখন বাজিমাত করে! আবার এর উল্টোটাও সত্য। যখন ব্যবহারকারীরা একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দেন, তখন খুব দ্রুতই তারা দলে দলে সেটি ছাড়তে থাকেন- আর এর পরিণাম হয় ভয়াবহ। মাইস্পেস বা বেবো'র কথাই চিন্তা করুন তাদের পরিণতি কি হয়েছিল।
চলুন দেখে নেওয়া যাক থ্রেডস অ্যাপটিতে কি কি সমস্যা রয়েছে:
টুইটারের যেমন দুটি ফিড রয়েছে- একটি হলো রেকমেন্ডেশন ফিড এবং অন্যটি শুধু যাদেরকে আপনি ফলো করবেন তাদের টুইট দেখার ফিড। কিন্তু থ্রেডস-এ শুধু একটি ফিড রয়েছে। সেই একটি ফিডেই ফলোয়ারস এবং অ্যাপের রেকমেন্ড করা কন্টেন্ট একসঙ্গে দেখা যাবে। আর সেটা অনেকের বিরক্তির কারণ হতে পারে।
আপাতত যা দেখা যাচ্ছে, এই অ্যাপটি এখনো ডেস্কটপে ব্যবহারের কার্যকারিতা তৈরি হয়নি; এটা কম্পিউটারে ভালো কাজ করে না, যা একটি লজ্জাজনক ব্যাপার।
থ্রেডসে কোনো ট্রেন্ডিং তথ্য আছে বলে মনে হচ্ছে না, ফলে কি কি ভাইরাল হচ্ছে তা বুঝতে পারা কঠিন হবে।
আর ভেরিফিকেশনের প্রসঙ্গে বলা যায়, ইউজাররা মাসিক ফি প্রদানের বিনিময়ে ব্লু টিক কিনতে পারবেন, ঠিক যেমনটা টুইটারে হয়।
জাকারবার্গ অ্যাপটিকে 'প্রাথমিক সংস্করণ' বলে অভিহিত করেছেন এবং এটা ব্যবহার করেও সেরকমই মনে হবে। শুধু প্রাথমিক স্তরের কাজগুলো এখানে করা যাচ্ছে। কিন্তু এটা এই মুহূর্তে একটা 'নো-থ্রিলস' অ্যাপ।
তবে এখনও পর্যন্ত এটির যা অর্জন, তাতে মেটার বস হয়তো খুশিতে পাগলপ্রায়! সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাকারবার্গ যেসব সমালোচনার মুখে পড়েছেন, তাতে এবার তিনি নতুন করে নিজেকে প্রকাশের মিশনে নেমেছেন- নিজেকে একজন সচেতন টেক বিলিয়নিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, যিনি একটা বন্ধুভাবাপন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম উপহার দিতে চান।
এদিকে জাকারবার্গের এসব কার্যকলাপ যে টুইটারের কর্তা ইলন মাস্ককে ক্ষুদ্ধ করেছে তা স্পষ্ট। থ্রেডস অ্যাপ চালু হওয়ার প্রসঙ্গে সোমবার তিনি ব্যঙ্গ করে টুইট করেছেন, "ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এটা এত বিচক্ষণতার সাথে চালিত হচ্ছে।"
কিন্তু জাকারবার্গের মনে যদি ভয় থাকে যে অসন্তুষ্ট টুইটার ব্যবহারকারীরা মেটার এই নতুন অ্যাপের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে... সেই ভয় আপাতত ভিত্তিহীনই মনে হচ্ছে।
আর যদি এমনটা হয়ও, কিন্তু এমন একটা অ্যাপ যেটি 'দুর্দান্তভাবে' না হোক, অন্তত চমৎকার কাজ করছে; তা ইলন মাস্কের জন্য সত্যিই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
Post a Comment