বিমানে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি কীভাবে সামলান চিকিৎসকেরা
ODD বাংলা ডেস্ক: আমির খান অভিনীত 'থ্রি ইডিয়টস' চলচ্চিত্রের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় অভিনেতা আর. মাধবন বুক ব্যাথার ভান করে বিমান থামিয়ে নেমে পড়েন। গল্পের প্রয়োজনে এমন মিথ্যে অসুস্থতা দেখিয়েছেন পরিচালক, তবে বাস্তবেও অনেক সময় বিমানে এমন জরুরি স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হয়। এমন অবস্থায় কি ব্যবস্থা নেওয়া হয় বা সেখানকার পরিস্থিতি কেমন থাকে, কোন ক্ষেত্রে বিমান অবতরণ করানো হয়? এসব প্রশ্নের উত্তরই দেওয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর। সিজ হেমাল তখন আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। ভারতে খুব কাছের এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ফিরছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে নয়াদিল্লি থেকে প্যারিস, এরপর এয়ার ফ্রান্সে চড়ে যাত্রা শুরু করেন নিউইয়র্কের উদ্দেশে।
বিমান উড্ডয়নের সময় হেমাল তার কানে হেডফোন লাগিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পর স্পিকারে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্সের কণ্ঠ শুনে এক গ্লাস শ্যাম্পেইন অর্ডারের কথা ভাবলেন তিনি। তবে অ্যাটেনডেন্সের কথা শুনে বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই। ফ্লাইটে কোন চিকিৎসক আছে কিনা খোঁজা হচ্ছে।
কাকতালীয়ভাবে হেমালের পাশে বসেছিলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সুসান শেফার্ড। দুইজন চিকিৎসক, যাদের এর আগে পরিচয় হয়নি তারা কথা বলে ঠিক করে নিলেন চিকিৎসা প্রক্রিয়া কী হবে।
কেবিন ক্রুর কাছে নিজের পরিচয় দিলেন হেমাল। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো দুর্দশাগ্রস্ত যাত্রীর কাছে। রোগী ৪০ বছর বয়সী এক নারী। তিনি পিঠে এবং পেটে প্রচণ্ড ব্যথার কথা জানালেন। সমস্যা কী, তা তখনো পরিষ্কার নয়। হেমাল প্রাথমিকভাবে ধারণা করলেন কিডনিতে পাথর বা অ্যাপেনডিসাইটিস।
এ সময় যাত্রী জানালেন তিনি গর্ভবতী। তখন হেমাল ও সুসান আশঙ্কা করতে লাগলেন, সে নারীর প্রসবকালীন ব্যথা দেখা দিতে পারে। বিমান তখন আটলান্টিক মহাসাগরের ওপরে, আশেপাশে অবতরণ করার মতো কোন বিমানবন্দরও নেই।
ড. হেমাল বলেন, আপনি ৩৫ হাজার ফুট উচ্চতায় আছেন, নিচে কেবল নীল জলরাশি দেখা যাচ্ছে। আপনি কল্পনা করতে পারবেন না তখন কী করা যায়।
দুই চিকিৎসক এরপর কিছুক্ষণ সে নারীর দেখাশুনা করলেন।
এর আগে নিজের চিকিৎসক সনদ নিতে প্রয়োজনীয় সাতটি প্রসব করান হেমাল। এবার তিনি এই অপারেশনের নেতৃত্ব দিলেন। ড. সুসান ও ক্রুদের সহায়তায় সফলভাবেই তিনি বিমানে সন্তান প্রসব করাতে পারলেন।
বিমানটি পরে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। মা ও শিশুকে নিরাপদে নামিয়ে নেওয়া নিকটবর্তী এক হাসপাতালে।
'বিমানে কি কোনো চিকিৎসক আছেন?'
সিনেমা কিংবা টিভিতে 'বিমানে কি কোনো চিকিৎসক আছেন?' বাক্যটি শুনে তা হয়তো আমাদের কাছে ক্লিশে লাগতে পারে। তবে বাস্তবতা এটিই।
অবশ্যই, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্সরা প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং বিভিন্ন ইন-ফ্লাইট মেডিকেল ইমার্জেন্সি মোকাবেলা করতে সক্ষম। তবে কখনো কখনো বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন তারা চিকিৎসক খোঁজেন। এছাড়া ভূমিতে থাকা চিকিৎসকদের সঙ্গেও তারা যোগাযোগ রাখেন। প্রয়োজন মনে হলে এবং সুযোগ থাকলে বিমান জরুরি অবতরণ করানো হয়।
কিন্তু সব সময় তো জরুরি অবতরণের সুযোগ থাকে না। তখন বিমানেই সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
অনেক সময় যাত্রী হিসেবে থাকা চিকিৎসকরা বিমানে বিশ্রাম নিতে থাকেন, ঘুমে থাকেন, মধ্যপান করেন কিংবা সিনেমা দেখেন। এমন অবস্থা থেকে হঠাৎ করে অসুস্থ ব্যক্তিকে সাহায্য করতে যেতে কেমন লাগে? এ প্রশ্নের উত্তরে হেমাল বলেন, নিজের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন কঠিন কিছু নয়। বেশ স্বাভাবিক একটি অনুশীলন। কর্তব্যরত অবস্থায় না থাকলেও অনেকে আমাদের কাছে পরামর্শ চান।
হেমাল বলেন, 'আমার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো সবসময় সাহায্য করা। তবে বিমানে চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে হয়তো সব চিকিৎসক এরকম মনোভাব রাখবে না।'
হেমাল আরও বলেন, 'সত্যি বলতে অনেক লোক এটি করতে চায় না, কারণ তারা ভীত, উদ্বিগ্ন থাকে। বিমান একটি ছোট জায়গা আর সেখানে সীমিত সুযোগ সুবিধা থাকে। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ না হয়েও রোগের চিকিৎসা করা লাগতে পারে।'
তবে বিমানে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা সাধারণত 'গুড সামারিটান এগ্রিমেন্ট' এ সাক্ষর করেন। মূলত এর মাধ্যমে চিকিৎসক অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটলেও মামলা কিংবা ক্ষতিপূরণ এড়াতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে এভিয়েশন মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্স অ্যাক্ট ব্যক্তিদের বিমানে জরুরী পরিস্থিতিতে সাহায্য করার জন্য আইনি দায় থেকে রক্ষা করে।
যদিও কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে তবুও সব সময় প্রয়োজনে সাহায্য করে যাবেন বলে জানান হেমাল। তার মতো একই রকম মন্তব্য করেন ড. লরেন ফেল্ড। এই গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট কয়েকবার বিমানে চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছেন।
ফেল্ড জানান, তিনি কখনো বিমানে বাচ্চা প্রসব করাননি, তবে একবার জরুরি অবতরণ করিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'আপনি বিমানে থাকা বাকি লোকদের কাছে বিরক্তির কারণ হতে পারেন। কারণ জরুরি অবতরণের ফলে দীর্ঘ ফ্লাইট আরো বিলম্বিত হতে পারে।'
ডা. সিজ হেমাল ২০১৭ সালে বিমানে এক নারীর প্রসবে চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছিলেন। সম্প্রতি সিএনএন ট্রাভেলের সাথে তিনি কথা বলেছেন যে, কিভাবে ডাক্তাররা ইন-ফ্লাইট মেডিকেল ইমার্জেন্সি পরিচালনা করেন। ছবি- সিএনএন
বিমানে রোগীর অবস্থা যাচাই
ফেল্ড ও হেমাল বলেন, বিমানে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জটিল দিক হলো রোগী সম্পর্কে আগে কিছু জানা না থাকা। হাসপাতালে চিকিৎসকের হাতে রোগীর স্বাস্থ্যগত ইতিহাস জানা থাকে। বিমানে আপনি সেটা জানেন না। বা তারা কী ওষুধ খাচ্ছে সে বিষয়ে ধারণা থাকে না। তারা নিজেরা যা জানায় তা থেকে শুরু করতে হয়।
প্রথমত চিকিৎসকরা হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকের মতো জরুরি অবস্থা কিনা যাচাই করে আশঙ্কামুক্ত থাকার চেষ্টা করেন।
বিমানে চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরো একটি সমস্যা হলো প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। বিমানে মেডিকেল কিট থাকলেও সেগুলো দিয়ে সব সময় কাজ সারা যায় না। যেমন বাচ্চা প্রসবের সময় সেলাই করার মতো কিছু ছিল না হেমালের কাছে। সৌভাগ্যবসত সেটার প্রয়োজন হয়নি।
এছাড়া বিমানের পরিবেশও কিছু চাপ বাড়িয়ে তোলে বলে জানান দুই চিকিৎসক। ইঞ্জিনের শব্দের কারণে স্টেথোস্কোপ দিয়ে শুনতে পাওয়া কষ্টকর হয়। বিমানে চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করার মতো কেউ থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তারা।
হেমাল বলেন, বিমানে সাধারণত নিম্ন রক্তচাপ বা ভাসোভ্যাগাল সিনকোপ দেখা দেয়। ভাসোভ্যাগাল সিনকোপ হলো অজ্ঞান হওয়ার একটি সাধারণ কারণ, অতি উদ্বেগে এমনটা হতে পারে।
অনেক সময় একই রকম লক্ষণ থাকায় উদ্বেগ তৈরি হয়। যেমন সম্প্রতি নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার সময় হেমাল একজন বয়স্ক ব্যক্তিতে জরুরি সেবা দেন। সে ব্যক্তি হৃদস্পন্দন জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। প্রথমে হেমালের মাথায় আসে হার্ট অ্যাটাকের বিষয়টি। পরে দেখা যায়, সে ব্যক্তি অতিরিক্ত মারিজুয়ানা ব্রাউনি খেয়েছেন। বিমানে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
জরুরি অবস্থায় চিকিৎসার সময়, ফ্লাইট ক্রুরা ভূমিতে থাকা মেডিকেল টিমের সাথে যোগাযোগ রাখে, যারা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
হেমাল বলেন, বাচ্চা প্রসব করার বিষয়টি ছিল একটি দলীয় প্রচেষ্টা। তিনি নেতৃত্ব দেন, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সহায়তা করেন। আর কেবিন ক্রুরা তাদের সাধ্যমত বাকি সবকিছু করেন। হেমালের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণ তিনি একজন সার্জন। আর সহায়ক হিসেবে সুসান ছিলেন প্রসবের পর শিশুর চিকিৎসার প্রয়োজনে।
হেমাল এয়ার ফ্রান্সের ক্রুদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা স্মরণ করেন। প্রথম দিকে, গর্ভবতী যাত্রীকে গোপনীয়তার স্বার্থে প্রথম শ্রেণীর কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। যাতে তিনি শুয়ে থাকতে পারেন।
ফ্লাইট ক্রুরা পাইলটদের সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ রাখছিলেন। হেমাল বলেন, যতটা সম্ভব মসৃণভাবে প্রসবের জন্য পাইলট 'টার্বুলেন্স' এড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
যাত্রীদের প্রতি পরামর্শ
হেমাল এবং ফেল্ড বলেন, যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরি। তারা পরামর্শ দিয়ে বলেন, আপনি যদি বিমানে থাকেন এবং আপনার পাশের বা কাছাকাছি কোনো যাত্রী চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হন, তাহলে সাহায্যের জন্য ডাকুন এবং ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টকে অবহিত করুন।
আপনি যদি প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত হন, তাহলে পালস পরীক্ষা করে দেখুন, প্রয়োজনে বুকে চাপ দিন। সাহায্যের জন্য ডাকতে ডাকতে এগুলো হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ।
ফেল্ড আরো বলেন, যাদের শারিরীক সমস্যা আছে তাদের উচিত উড্ডয়নের আগে নিজের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা।
Post a Comment