যেখানে মৃতদের নিবাসের দাম জীবিতদের বাসস্থানের চাইতেও বেশি!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: একটা জুতার বাক্সের চাইতে খুব বেশি বড় নয়- এটুকু জায়গার দাম শুরু হয় ৫৩,০০০ ডলার থেকে এবং এর অবস্থানও বিশ্বের সবচেয়ে দামি প্রপার্টি মার্কেট হিসেবে পরিচিত একটি নগরীতে। কিন্তু হংকং এর ১২তলা শান সুম টাওয়ারের সাদা মার্বেল পাথরের ইন্টেরিয়র কোনো সাধারণ ক্রেতার জন্য নির্মিত হয়নি। এগুলো নির্মিত হয়েছে বিশেষ গ্রাহকদের জন্য, যারা আর দশটা মানুষের চাইতে একটু ভিন্ন কিছু চান: মৃত্যুর পরেও একটি বিশেষ বিশ্রামাগার খোঁজেন!


বেসরকারিভাবে পরিচালিত এই আকাশচুম্বী কলামবারিয়াম (মৃতদেহের ভস্ম সংরক্ষণ করার জন্য নির্মিত ঘর বা ভবন) এর ডিজাইন করেছেন জার্মান স্থপতি উলরিখ কিরশহফ এবং এখানে ২৩,০০০ মানুষের সৎকার-পরবর্তী দেহাবশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগ যে সস্তায় মিলবে না তা ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে।


এই কলামবারিয়ামে সিঙ্গেল আর্ন এন্ট্রি ইউনিট (একক ভস্মাধার) ছাড়াও রয়েছে কিছু কুলুঙ্গি, যেখানে একসাথে দুটি ভস্মাধার রাখা যাবে এবং এর খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ৭৬,০০০ ডলার। অন্যদিকে, ফ্যামিলি ইউনিটও রয়েছে যেখানে একসঙ্গে আটজনের দেহভস্ম রাখা যাবে এবং খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ৪৩০,০০০ ডলার। 


শান সুম কলামবারিয়াম টাওয়ারে স্ট্যান্ডার্ড মাপের কুলুঙ্গি বা ভস্মাধার রাখার জায়গাটি এক কিউবিক স্কয়ার ফুটের। কিন্তু বলা হয়ে থাকে যে, টাওয়ারের এই ছোট্ট জায়গাটুকুর মূল্য শহরের সবচেয়ে দামি আবাসিক প্রপার্টির চাইতেও বেশি। কারণ গত মার্চেই হংকংয়ের সবচেয়ে দ্য পিক অভিজাত এলাকায় একটি অট্টালিকার প্রতি বর্গফুটের দাম হাঁকা হয়েছিল ৩২,০০০ মার্কিন ডলার।


তবুও পুরনো শিল্প জেলা কোয়াই চুং-এ অবস্থিত শান সুমই যে হংকংয়ে 'মৃতদের জন্য' সবচেয়ে ব্যয়বহুল নিবাস, তা কিন্তু নয়। হংকংয়ের কনজ্যুমার কাউন্সিলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেহভস্ম রাখার জন্য সবচেয়ে ব্যয়বহুল কমপ্লেক্সটি অবস্থিত ফ্যানলিং শহরে। মন্দিরের মতো দেখতে এই কলামবারিয়ামে দেহভস্ম রাখার জন্য গুনতে হবে ৬৬০,০০০ ডলার! সেইসঙ্গে ম্যানেজমেন্ট ফি হিসেবে দিতে হবে কমপক্ষে ২৫,০০০ ডলার।



পরকালের কথা বিবেচনায় এই বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করা হয়তো অনেকের কাছে তেমন খারাপ আইডিয়া নয়; কিন্তু শান সুমের মতো বেরকারি কলামবারিয়ামগুলোতে দেহভস্ম চিরকাল সংরক্ষণ করা যাবে না। যতদিন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাইভেট লাইসেন্স থাকবে (যা হংকং সরকার অনুমোদিত) থাকবে ততদিন পর্যন্ত এখানে দেহভস্ম রাখা যাবে। এই লাইসেন্সের মেয়াদ থাকে ১০ বছর, কিন্তু লাইসেন্স পেতেই বছরের পর বছরের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।


মৃত্যুর পরেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা!


'শান সুম' শব্দের অর্থ সদাশয় হৃদয়। এটা স্রেফ দেহভস্ম রাখার জায়গার চাইতেও বেশি কিছু। স্থপতি উলরিখ কিরশহফ সিএনএনকে বলেন, পূর্বসূরিদের দেহাবশেষ পরিদর্শন করতে আসা পরিবার-পরিজনের জন্য পকেট গার্ডেনের পাশাপাশি একটি অ্যাক্সেসিবল রুফটপ এবং উইন্ডিং ব্যালকনি রয়েছে। অন্যদিকে, ভবনের এক পঞ্চমাংশ জায়গাই খোলা রাখা হয়েছে। এছাড়াও, নান্দনিকতার কথা মাথায় রেখে ঢেউ খেলানো রূপ দেওয়া হয়েছে এই ভবনটির নকশায় এবং চীনা কবরস্থানের চিরাচরিত নকশা অনুকরণ করা হয়েছে এখানে।


তবে কলামবারিয়ামটিতে আধুনিকতার ছাপও রয়েছে। যেমন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং ডিহিউমিডিফায়ার (আর্দ্রতা হ্রাস করার প্রক্রিয়া), এমনকি একটি অ্যাপও রয়েছে যার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা আগে থেকেই একটি টাইম স্লট বা সময় ঠিক করতে পারেন যে কখন তারা প্রয়াত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসবেন।


শান সুম টাওয়ার আসলে সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যবসায়ী নারী মার্গারেট জি'র মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা। অলঙ্কার ও রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় তিনি প্রচুর টাকা আয় করেছেন এবং এখন তিনি নিজের নামে একটি দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করেন।


সিএনএনকে জি বলেন, চীনা সংস্কৃতিতে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হয় এবং অনেক মানুষই এই প্রথাকে সম্মান জানানোর জন্য সবকিছু করতে রাজি।


"আমাদের প্রিয় মানুষদের' শেষযাত্রা শুধু তাদের পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া নয়, বরং আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের উচিত প্রিয়জনদের যথাযথভাবে বিদায় জানানো, বলেন জি। তিনি আরও যোগ করেন, 'শুধু তাদের সমাহিত করার ব্যবস্থা করলেই চলবে না, তাদের আত্মা যেন শান্তিতে থাকে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে।'


২০০৭ সালে জি'র স্বামী মারা যাওয়ার পর তাকে সমাহিত করা এবং একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে গিয়ে বেশ জটিলতায় পড়তে হয় জি'কে। এরপরেই তিনি উপলব্ধি করেন যে তাদের দেশে মৃতদের সম্মান জানানোর মতো জায়গার ঘাটতি রয়েছে।


জীবিত বা মৃতদের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই


হংকংয়ে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে যে অসামঞ্জস্য, এর ফলে আবাসনের মূল্য দিন দিন বেড়েই চলেছে যার প্রভাব পড়েছে কলাম্বারিয়ামগুলোর ওপরেও। 


হংকং যদিও ছোট শহর নয়- এর আয়তন নিউইয়র্ক সিটির চাইতেও ১.৪ গুণ বড়। ১১১০ বর্গকিলোমিটারের এই অঞ্চলের পাহাড়ি ভূখণ্ডের জন্য উন্নত স্থাপনা নির্মাণের মতো উপযুক্ত জায়গা কমে এসেছে।


জায়গা স্বল্পতার কারণেই ডেভেলপাররা আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে বেশি আগ্রহী, যাতে বেশি মানুষকে জায়গা দেওয়া যায়। এর ফলে গড়পরতা বাসার আকার হয় ৪৩০ বর্গফুট যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম বাসাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তবুও বাসাগুলোর মূল্য গড়ে এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।


জীবিতাবস্থায় জায়গার স্বল্পতা নিয়ে যে সংগ্রাম, মৃত্যুর পরেও তা চলতে থাকে! তার উপর রয়েছে হংকংয়ের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধ জনসংখ্যার চাপ। আদমশুমারি ডেটা অনুযায়ী, হংকংয়ে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ব্যক্তির বয় ৬৫ বছরের উর্ধ্বে এবং ২০৬৯ সালের মধ্যে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন এমন বয়সের মানুষ পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


'দ্য হংকং ওয়ে অব ডেথ'


যদিও ৯০ শতাংশ হংকংবাসী মৃত্যুর পর অগ্নিসৎকারেই বিশ্বাসী, কিন্তু সেই দেহভস্ম সংরক্ষণ করার জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে। এর কারণ, অন্য অনেক জাতির মতো দেহভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া বা বিসর্জন দেওয়ার পরিবর্তে প্রথাগত রীতিতে বিশ্বাসী চীনারা এই ভস্ম একটি স্থানে সংরক্ষণ করাকেই বেছে নেন, যেখানে তারা মাঝেমধ্যে এসে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন।


গত এক দশকে হংকংয়ে মৃত্যুর হার ছিল বছরে ৪৬,০০০ (শান সামের ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ), কিন্তু কলামবারিয়ামের ধারণক্ষমতা সেই তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি।


বর্তমানে সরকার-পরিচালিত পরিষেবাগুলোর মধ্যে মাত্র ১৩৫,০০০ 'পাবলিক নিশ' বা ভস্মাধার সহজলভ্য রয়েছে যা ২০ বছরের জন্য লিজ নিতে হলে ৩০০ ডলার খরচ করতে হবে। কিন্তু এখানেও প্রতিযোগিতা অনেক বেশি এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো কোনো পরিবার জানিয়েছে যে তাদেরকে জায়গা পেতে কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।


জনসাধারণের কথা বিবেচনা করে সরকার ২০১৭ সাল থেকে শান সুমসহ ১৪টি বেসরকারি কলামবারিয়াম অপারেটরকে লাইসেন্স দিয়েছে।


ফুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হাইজিন ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র সিএনএনকে বলেন, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৭৭,০০০ ভস্মাধার তৈরি করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে আরও চারটি নতুন লোকেশন নির্মাণ সম্পন্ন হবে, ফলে আরও ১৬৭,০০০ ইউনিট জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে।


অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা 


হংকংয়ের মতো বাণিজ্যিক নগরীতে যেখানে মানুষের গড় মধ্যক পারিশ্রমিক মাত্র ২৪০০ ডলার; আবার অন্যদিকে বিলিয়নিয়ারেরও অভাব নেই (ওয়েলথ এক্স এর তথ্যানুযায়ী, একশোর অধিক বিলিয়নিয়ারের বাস এই শহরে)। ফলে দেহভস্ম রাখার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করতে আগ্রহীদের জন্যও বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। আর শান সুম তেমনই একটি জায়গা।


কোয়াই চুং জেলায় অবস্থিত এই কলামবারিয়ামের বিভিন্ন তলায় বিভিন্ন ধর্মের প্রয়াত ব্যক্তিদের বিভিন্ন রীতি অনুযায়ী দেহভস্ম রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে, জানান জি'র ছেলে পান তং। তিনি এই ভবনটির অপারেশনাল ডিরেক্টর।


উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন- বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আকৃষ্ট করার জন্য হালকা, উজ্জ্বল ধরনের কুলুঙ্গির নকশা করা হয়েছে। আবার গুয়ানিন দেবীর অনুসারীদের জন্য যেসব কুলুঙ্গি তৈরি করা হয়েছে সেখানে এই দেবীর ছবি রাখা হয়েছে।


আবার একটি তলায় ধর্মনিরপেক্ষদের জন্যও জায়গা রাখা হয়েছে, সেখানে প্রতিটি কমপার্টমেন্টে চীনা স্টাইলে 'ছাদ' রাখা হয়েছে এবং মৃত্যুর পর সমৃদ্ধ জীবন কামনা করে গোল্ড কয়েন দিয়ে ডাবল ডোর সাজানো হয়েছে।


পান তং বলেন, "এগুলোর নকশা বাছাই করার ক্ষেত্রে আমার নিজেকেই মৃত ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করতে হয়েছে, ভাবতে হয়েছে যে আমি মারা যাওয়ার পর কেমন পরিবেশে থাকতে চাইতাম। সে অনুযায়ী কুলুঙ্গিগুলো তৈরি করা হয়েছে।"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.