ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিত্রকলার বাজারও যেভাবে লাভজনক করে তুলেছিল

 


ODD বাংলা ডেস্ক:১৭৮০ সনের ফেব্রুয়ারির কোন একদিন। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শেষে ক্লান্ত, অসুস্থ এক ইংরেজ পৌঁছালেন ভারতের মাদ্রাজ উপকূলে। জাহাজ থেকে ছোট্ট নৌকায় করে তীরে যখন আসছিলেন, তখনই – স্বচ্ছ সুনীল আকাশ, উজ্জ্বল রোদে ঝলমলে সৈকত, দূরের সমতল ছাউনির সাদা ভবনের দৃশ্যপট – প্রথম দর্শনেই মন্ত্রমুগ্ধ করে তাকে। এই অপার সৌন্দর্য তার নিজের শহর লন্ডনের সম্পূর্ণই বিপরীত।


ইংরেজ সাহেবটি যখন ভারতে পা রাখেন, যুদ্ধের দামামা তখন বাজছে। ভারতের মাটিতে ইংরেজ-ফরাসী যুদ্ধের বিস্তার ঘটেছে। ফরাসীদের মিত্র মহীশূরের হায়দার আলীর সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রচণ্ড যুদ্ধও চলমান। ১৭ শতক থেকেই মাদ্রাজে ইংরেজদের শক্তিশালী এক দুর্গ ছিল ফোর্ট সেন্ট জর্জ। বেসামরিক নাগরিক হওয়ায়, যুদ্ধ না থামা পর্যন্ত নবাগত ইংরেজ সাহেবকেও এই দুর্গের নিরাপদ এলাকাতেই অবস্থান করতে হয়েছিল। এই সময়টা আশেপাশের গ্রামীণ এলাকার ছবি এঁকে কাটান তিনি। আসলে এজন্যই তো তার ভারতে আগমন: উইলিয়াম হজেস ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়োগ করা প্রথম ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্ট।


ঘরে বাইরে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতির সাথে তাদের সহাবস্থান ও যোগাযোগের মুহূর্ত, জলবায়ুর বৈচিত্র্য, ভিন্ন ভিন্ন ভূমিরূপের সৌন্দর্য – ক্যানভাসে এসব ফুটিয়ে তোলাই একজন ভূচিত্রকরের কাজ। 


১৮ শতকের গোড়ার দিক থেকেই ভারতবর্ষে অনেক ইউরোপীয় শিল্পী আসতে থাকেন। তাদের মধ্যে উইলিয়াম হজেস সম্ভবত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। অবশ্য এর আগেও ভারতে অনেক ইউরোপীয় শিল্পী এসেছেন। কিন্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত হতে থাকলে– তা নতুন মাত্রা লাভ করে। 


এসময়ে, লন্ডনের শিল্পকলার বাজারে বহির্বিশ্বের শিল্প ও চিত্রকর্মের ব্যাপক চাহিদা দেখা দেয়। এনিয়ে শিল্পীদের মধ্যেও শুরু হয় প্রতিযোগিতা। ধনী ও বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টায় ইউরোপের অনেক শিল্পী সুদূরের উপনিবেশগুলোয় ভ্রমণ করেন। শিল্পকলা এভাবে উপনিবেশবাদের সুবাদে এক লোভনীয় ব্যবসায় পরিণত হচ্ছিল। 


তবে এখনকার মতো তখনকার দিনেও শিল্পীদের ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত। ছবি আঁকা বাবদ– পৃষ্ঠপোষকদের দেওয়া কমিশনের ওপরই নির্ভর করতে হতো।  


ঔপনিবেশিক বাণিজ্য ও শিল্পকলার সম্পর্ক 


১৫ শতকের শেষ নাগাদ বাণিজ্যের অন্তর্জাল পৃথিবীর নানান প্রান্তে বিস্তৃত হতে থাকায়– পণ্য ও মানুষের চলাচলও বাড়তে থাকে। ইউরোপীয় শক্তিগুলো এসময় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল দখল করতে শুরু করে। তারা শুধু উপনিবেশগুলোর সম্পদ লুট করছিল না, নতুন অনেক পণ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানছিল। এভাবেই প্রাচ্যের উন্নত বস্ত্র, মশলা, চা ও আফিমের মতো পণ্য ব্যবহারের চল শুরু হয় ইউরোপে।


উপনিবেশের শিল্পকলা ও নান্দনিক বস্তুর এক বিশ্ববাজার গড়ে ওঠে।  ইউরোপীয় ধাঁচে আঁকা প্রাচ্যের ছবির কদরও তৈরি হয়, ফলে শিল্পীরাও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটতে থাকেন, সেখানকার ছবি এঁকে ভালো আয়ের আশায়।  


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বৈশ্বিক এই চিত্রশিল্পের বাজার সম্ভাবনাকে গোড়াতেই উপলদ্ধি করে। ফলে অন্যান্য পণ্যের মতোন তারা শিল্পকলা বাণিজ্যেরও প্রধান সুফলভোগী হয়। ১৭৩৫ সনের হগার্থ অ্যাক্টের মাধ্যমে বই কপির মতোন মেধাসত্ত্ব লাভ করে অঙ্কিত চিত্র, ফলে লন্ডন হয়ে ওঠে শিল্পীদের এক তীর্থ। লন্ডনে শিল্পীদের কপিরাইটের নিরাপত্তা ছিল। অন্যদিকে ইউরোপের অন্যান্য শিল্পকলার কেন্দ্রগুলোয় নকল ও হুবহু কপি অবাধে বেচতো আর্ট ডিলাররা। এতে মূল শিল্পীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন।   


তবে সমঝদার সবার পক্ষেই মোটা টাকায় আসল ছবি কেনার সামর্থ্য ছিল না। নকলবাজেরা সেই শূন্যতাই পূরণ করছিল। এই অবস্থার পরিবর্তন আসে ১৮ শতকে মুদ্রণ বা প্রিন্টিং প্রযুক্তির বিপ্লবের হাত ধরে। ফলে আসল ছবির অবিকল কপি শিল্পীকে রয়্যালটি দিয়ে বৈধভাবেই ছাপানো সম্ভব হয়।  


ধনী নন, কিন্তু স্বচ্ছল ও শিল্পের গুণগ্রাহী – ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতের এমন উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এর মূল গ্রাহক হয়ে ওঠেন। চিত্রশিল্পের অন্যতম বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্য আছে এমন ধ্যানধারণা প্রভাবিত ছবি আঁকিয়ে নিত তারা। কোম্পানির কমিশনভূক শিল্পীরা কর্তাদের নির্দেশমতো এ ধরনের যেসব ছবি এঁকে গেছেন, তার পরিমাণ– বাস্তব ও কল্পনার মিলমিশে এক সাম্রাজ্যের সমতুল্য। 


শুধু ভূপ্রকৃতির দৃশ্য আঁকতে নয়, শিল্পের মাধ্যমে কোম্পানি নিজেদের গুরুত্ব ও মহিমা প্রচার করেছে। যেমন অনেক সময় সেনাদলের সাথে শিল্পীদের পাঠানো হতো, এই শিল্পীরা যুদ্ধের মোড় পরিবর্তনকারী কোনো দৃশ্যের ছবি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন। ইংল্যান্ডে মানুষ ছবিগুলো দেখে কোম্পানি সম্পর্কে আরো ইতিবাচক ধারণা পেত, উপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা জনমনে আরো প্রতিষ্ঠা লাভ করতো। এদিক থেকে বলা যায় কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষারও এক মাধ্যম হয়ে ওঠে চিত্রকলা।  


এই ঘটনার একটি নেতিবাচক দিকও ছিল। আগে শিল্পীরা স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ পেতেন। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একপর্যায়ে অনুমতি সাপেক্ষেই তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শিল্পীদের (যারা কোম্পানির কর্মচারী নন) যেতে দিত। তাদের থেকে শিল্পকর্মের হ্যান্ডলিং চার্জও আদায় করতো কোম্পানি। হজেসও একজন ভ্রমণকারী শিল্পী হয়ে ওঠেন। 


ভূমির বিভিন্ন রূপ, প্রাকৃতিক দৃশ্য, সৌধ, রাজন্যবর্গ, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান দৃশ্য– ইউরোপীয় শিল্পীদের ভারতবর্ষে আঁকা ছবির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ক্যানভাসে আরো ঠাঁই পায় বিপুল জনবৈচিত্রের উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের যাপিতজীবন, পেশা ইত্যাদি। চিত্র প্রদর্শনীগুলোয় খুব দ্রুতই দর্শকদের আকর্ষণ করতে শুরু করে এ ধরনের ছবি। সম্পন্ন ইংরেজরা তাদের শাসনাধীন উপনিবেশের নগর, গ্রাম, ভূপ্রকৃতি তুলে ধরা এসব ছবি কিনতে মোটা দাম দিতেও কার্পণ্য করতেন না।  

                                                        

ভারতে উইলিয়াম হজেস


ভারতে আসার আগেই অতুলনীয় এক ক্যারিয়ারের অধিকারী ছিলেন হজেস। প্রথমে থিয়েটারের ব্যাকড্রপ আঁকার কাজ করতেন, সেখান থেকে শীর্ষে উঠে এক সময় লাভ করেন রয়্যাল আর্ট গ্যালারির সম্মানজনক সদস্যপদ। বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন কুকের দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অভিযানেও সঙ্গী হন তিনি। এসময় এঁকেছেন মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ, সেগুলোর বাসিন্দা, উপসাগর ও খাঁড়ির ছবি। 


ইতোমধ্যেই লন্ডনে একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হওয়ায় – হজেসকে ভারতবর্ষে আসার আমন্ত্রণ জানান বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। এরপর কোম্পানির থেকে অনুমতি নিয়ে ১৭৭৯ সনে ভারতগামী জাহাজে চেপে বসেন হজেস, মাদ্রাজে পৌঁছান তার পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে।  


দীর্ঘ যাত্রায় কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন হজেস, সুস্থতা লাভের পর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এলাকার বেশকিছু ছবি আঁকেন তিনি। এরমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো তাঞ্জোরের (তৎকালীন তাঞ্জাবুর) মন্দিরগুলোর ছবি। 


ভারতবর্ষে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে 'ট্রাভেলস ইন ইন্ডিয়া' নামক বইও লেখেন হজেস। সেখানে তিনি জানান, তাঞ্জাবুরে তিনি চোলা যুগের বিখ্যাত বৃহদীশ্বর মন্দিরের ছবি এঁকেছেন। পরবর্তীতে অন্যান্য ছবির সাথে মন্দিরের ছবিগুলো জেনারেল বার্কার ইস্ট ইন্ডিয়াম্যান নামক জাহাজে করে লন্ডনে পাঠানো হয়। কিন্তু, গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ১৭৮১ সালে জাহাজটি হল্যান্ডের উপকূলে ডুবে যায়। ফলে হজেসের ছবিগুলোও হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে একজন জরিপকারীর আঁকা চিত্রের সূত্র ধরে তাঞ্জাবুরের মন্দিরটির ছবি ফের আঁকেন তিনি। 


ভারতবর্ষে আসার এক বছর পর ১৭৮১ সালে কলকাতা পৌঁছাতে পেরেছিলেন উইলিয়াম হজেস। সেখানে তাকে বার্ষিক ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেন গভর্নর হেস্টিংস। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্থানের ধারাবাহিক ঘটনাগুলো চিত্রকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করার দায়িত্বটি এভাবেই হজেসের ওপর বর্তায়। 


নিয়োগের এক মাস পর– প্রথমে বিহারের রাজমহল পাহাড়, তারপর ভাগলপুরে যান এ শিল্পী। ভাগলপুরের কমিশনার অগাস্টাস ক্লিভল্যান্ড প্রতিভার পরিচয় পেয়ে– হজেসের আরেক পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন।  


এরপর উত্তর ভারত ভ্রমণে বের হন হজেস; এই যাত্রাকালে স্থানীয় প্রকৃতি, পাহাড়, জনতা ও আচার-অনুষ্ঠানের অনেক দৃশ্যের অন-স্পট ড্রয়িং এঁকেছেন তিনি। 


ভারতে অবস্থানের সময় হজেস প্রায় ৯০টি অন-স্পট ড্রয়িং এবং কিছু তৈলচিত্রও আঁকেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো, তার আঁকা বেনারসের ঘাট, গোয়ালিয়র দুর্গ ও তাজমহলের ছবিগুলো। 


১৭৮৩ সনে লন্ডনের উদ্দেশে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন হজেস। যাওয়ার আগে, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পাঁচটি চিত্রকর্ম তিনি কোম্পানি বাহাদুরকে উপহার দেন। এগুলো হলো– আগ্রার দৃশ্য, মোগল সম্রাট আকবরের সমাধিসৌধ, গোয়ালির দুর্গ এবং লখনৌ এর শাহীমহলের ছবি। 


১৭৮৪ সনের জুনে লন্ডনে পৌঁছানোর পর ভারতে আঁকা ৪৮টি অন-স্পট ড্রয়িংয়ের ওপর ভিত্তি করে অ্যাকুয়াটিন্ট প্রক্রিয়ায় 'সিলেক্ট ভিউজ ইন ইন্ডিয়া' নামক সিরিজ তৈরির কাজে হাত দেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিই তিনি ছবির বইটি উৎসর্গ করেছিলেন।


এর অনেক বছর পর ১৭৯৩ সনে হজেস তার 'ট্রাভেলস ইন ইন্ডিয়া ইয়ারস ১৭৮০, ১৭৮১, ১৭৮২ অ্যান্ড ১৮৮২' নামক ছবির বই প্রকাশ করেন। 


নিজের আঁকা ছবিগুলো বিভিন্ন উপলক্ষে রয়্যাল একাডেমিতে প্রদর্শন করেন হজেস। একসময় রয়্যাল একাডেমির আবাসিক শিল্পী হওয়ার সম্মানও লাভ করেন। 


উপনিবেশবাদের সাথে চিত্রকর্মের সম্পর্ক  


প্রধানত রাজনৈতিক-অর্থনীতির আঙ্গিকেই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বেশিরভাগ সময়েই প্রাধান্য পেয়েছে পণ্য বাণিজ্য ও শিল্প-পর্যায়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা– এবং ভারতীয় ও ব্রিটিশ অর্থনীতিতে তার প্রভাব। 


কিন্তু, অর্থনীতির পাশাপাশি অন্য ক্ষেত্রেও উপনিবেশবাদের গভীর অবস্থান ছিল। পণ্য ভোগের পাশাপাশি ভারতবর্ষের মশলার স্বাদ, উৎকৃষ্ট আতরের সুবাস, উন্নত বস্ত্রের পরিধানের আভিজাত্য –  ভোগবাদী কল্পনাকে উৎসাহিত করে। ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলায়- যার ছাপও পড়ে। ভোগবাদী সমাজে ভারতের অভূতপূর্ব ছবি দেখা বা অন্যান্য ভারতীয় শিল্পকলা উপভোগের এক নান্দনিক চাহিদা তৈরি হয়।


এই শিল্প ছিল শাসকের দৃষ্টি দিয়ে শোষিতকে দেখার। ঐতিহাসিক হোলগার হুক তাই হয়তো বলেছেন, 'উপনিবেশবাদ ছিল তীব্রভাবে দৃশ্যমান এক বিষয়।' 


একইভাবে ঔপনিবেশিক যুগের ভারতের ছবিগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রকে অকপটে তুলে ধরে। যে কোম্পানির হাত ধরেই ভারতে আঁকা ইউরোপীয় শিল্পীদের চিত্রকর্ম বৈশ্বিক শিল্পবাজারে আসতো।  


তবে ১৮ শতকের শেষদিক থেকে শুরু করে ১৯ শতকের শুরু পর্যন্ত- যখন ফোটোগ্রাফির উত্থান ইউরোপীয় সমাজে শিল্পভোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠেনি, তখন পর্যন্ত অনেক ভারতীয় শিল্পী ব্রিটিশদের অধীনে কাজ করেছেন; আবার ব্রিটিশ শিল্পীরাও কখনো ব্রিটিশ, কখনোবা স্থানীয় রাজা-নবাবদের অধীনে কাজ করেছেন। 


এই সময়ে শিল্পীরা তাদের ছবির জন্য নতুন নতুন থিম বা আইডিয়া খুঁজতেন। খুঁজতেন উদার পৃষ্ঠপোষক। পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক শিল্পীই এসময় ভারতবর্ষে আসেন। কিন্তু, সবার ভাগ্য হজেসের মতো অনুকূল ছিল না। 


১৭৮৩ সাল নাগাদই কলকাতার শিল্পকলার বাজার প্রচণ্ড প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। নতুন আগত শিল্পীরাও উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষক পাচ্ছিলেন না। আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গ্রাসে এসময়ে স্থানীয় রাজন্যদের বিত্ত ও ক্ষমতা দুইই হ্রাস পেতে থাকায়– তাদের অনেকেই মোটা বেতনে একাধিক শিল্পীর ভরণপোষণ করতে আর আগ্রহী ছিলেন না।  


তাই আরো ভালো পৃষ্ঠপোষকের খোঁজে এক রাজার দরবার থেকে অন্য দরবারে শিল্পীদের আনাগোনা লেগেই থাকতো। 


ভারতে শিল্পীদের টিকে থাকার সংগ্রাম ও সাফল্য


শিল্পীদের ভারতে আসতে হলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুমতি নিতে হতো এবং ভালো আচরণের অঙ্গীকার করে একটি বন্ডে সই করতে হতো। 


শিল্পকর্মের প্যাকেজিং ও পরিবহন ভাড়াসহ বিভিন্ন রকম হ্যান্ডলিং চার্জ আদায় করতো কোম্পানি। এছাড়া, ক্যানভাসের আকারের ওপর নির্ভর করে এগুলোর ওপর আমদানি শুল্ক ধার্য করা হতো। 


আগেই বলা হয়েছে, সব শিল্পীর ভাগ্য হজেসের মতো সুপ্রসন্ন ছিল না। এমন একজন বিখ্যাত ইংরেজ চিত্রকর ছিলেন ওজাইস হামফ্রি, প্রথমে মাদ্রাজে তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জন ম্যাকফার্সন। পরে লখনৌ এর দরবারে শিল্পীর চাকরি নেন তিনি। কিন্তু, সেখানে জোহান জোফানি ও চার্লস স্মিথের মতো শিল্পীদের প্রসিদ্ধির কারণে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। পরে চলে যান কলকাতায়।


কলকাতায় আবার ল্যান্ডস্কেপ শিল্পী জর্জ চিনারির রমরমা থাকায়– সেখানে বিশেষ সুবিধা করতে পারছিলেন না রবার্ট হোমের মতো প্রতিষ্ঠিত পোট্রেট শিল্পী। 


তবে বাণিজ্যিক দিক থেকে অনেকেই সাফল্য লাভ করেন। 


যেমন অযোধ্যার নবাব সুজা উদ দৌলার পৃষ্ঠপোষকতয় টিলি কেটেল ১৭৬৯ থেকে ১৭৭৬ পর্যন্ত ভারতে থাকার সময় সফল শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তার তৈরি পোট্রেটগুলো সেকালে বিকোতো ৪ থেকে ৫ হাজার রুপি দরে।


উত্তর ভারতে ল্যান্ডস্কেপ চিত্রকর থমাস ড্যানিয়েল ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল, বোম্বাইতে জেমস ওয়ালেস ও জন জুকস, এবং কলকাতার জর্জ চিনারি– এদের সবাই তাদের ছবির মাধ্যমে বিশেষ সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। অবশ্য তাতে সবাই ধনী হয়েছেন এমন নয়। 


যেমন ড্যানিয়েল ভাইদের লটারির টিকেট বিক্রি করে ছবি আঁকার কাজ করতে হয়েছে। অন্যদিকে, ব্যাপক প্রসিদ্ধি পাওয়ার পরেও, একপর্যায়ে আয়ের চেয়ে দেনাই বেশি হয়ে যায় জর্জ চেনারির। পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে একসময় তিনি চীনের ম্যাকাও পালিয়ে যান। 


উপনিবেশিক ভারতের ব্রিটিশ চিত্রকলা নিশ্চিতভাবে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। তবে তার রূপ ভিন্নভাবেও দেখার সুযোগ আছে। যেমন প্রাকৃতিক দৃশ্য বা ভূমির বিভিন্ন রূপ ফুটিয়ে তোলা ল্যান্ডস্কেপগুলোয় উত্তাল, অস্থির সে সময়ের ছাপ নেই। বরং, ক্যানভাসে তুলে ধরা হয়েছে নির্মল প্রকৃতির দৃশ্য। উঠে এসেছে নগর, বন্দর ও জনপদের শান্ত, আদর্শ রূপ। তাই ভারতে কোম্পানি রাজের প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত হওয়ার পরও এগুলোর আবেদন আজও অমূল্যই রয়ে গেছে।  

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.