হাই হিলকে কি বিদায় জানানো হয়ে গেছে!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ক্রমপরিবর্তনশীল ফ্যাশন জগতে যেখানে বিভিন্ন মৌসুমে একেকটা ট্রেন্ড কিছুদিন তুমুল জনপ্রিয়তা পায়, আবার হারিয়ে যায়; সেখানে সুনির্দিষ্ট একটি পরিবর্তন হয়তো ইতোমধ্যে অনেকেরই চোখে পড়ার কথা, আর তা হলো: হাই হিলের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া। মনে করে দেখুন তো, শেষবার কবে আপনি হাই হিল খটখট করে কাউকে হেঁটে যেতে দেখেছেন?


একসময় সুরুচি ও আভিজাত্যের এবং 'নারীত্বের' উজ্জ্বল প্রতীক হাই হিল অনেকটা নিঃশব্দেই লাইমলাইট থেকে সরে গিয়েছে, তার বদলে নারীদের পায়ে জায়গা করে নিয়েছে আরামদায়ক জুতো।


হাই হিলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার এই যুগান্তকারী মাস্টারস্ট্রোকের পেছনে কি করোনাভাইরাস মহামারিই দায়ী? একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে কোভিড যেমন আমাদের অনেকের জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছে, একইসঙ্গে ফ্যাশন ও স্টাইলের জগতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রেখেছে।


সারা বিশ্বে হাই হিলের আবেদন এর আগে কখনোই মলিন হয়নি; যেকোনো পরিস্থিতিতেই সগর্বে দাঁড়িয়ে ছিল নারীদের ফ্যাশনের এই অংশটি। নানা ডিজাইনের হাই হিল শুধুমাত্র নারীর উচ্চতাই বাড়িয়ে দেয়নি, একইসঙ্গে নিছক পোশাকের বাইরে গিয়েও নারীর আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তুলেছে। হাই হিলকে শুধুমাত্র ফুটঅয়্যারের কাতারে ফেলা হয়নি, বরং এটিকে আত্মবিশ্বাস, আকর্ষণীয়তা এবং গ্ল্যামার অর্জনের একটা উপায় বলেও মনে করা হতো। 


"হাই হিল একজন ব্যক্তির অঙ্গভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে এবং স্বতন্ত্র একটা হাটার স্টাইল তৈরি করে যা একজন ব্যক্তির নিজেকে উপস্থাপনের ধরন বদলে দিতে পারে, তাকে আরও টানটান-দৃঢ়ভাবে দাড়াতে সাহায্য করে এবং এতে অন্যদের কাছ থেকে প্রশংসাও লাভ করতে পারে। এর ফলে ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস আসে এবং সে বুঝতে পারে যে লোকে তার দিকে তাকাচ্ছে এবং এটাকে নারীত্ব, গ্ল্যামার বা পেশাদার ক্ষেত্রে খুব আভিজাত্যের চোখে দেখছে", বলেন 'দ্য সাইকোলজি অব ফ্যাশন' বইয়ের লেখক এবং কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট ও ফ্যাশন-ব্যবসায়িক কনসালটেন্ট ডা. কলিন মেয়ার।


নতুন জীবনে নতুন বিষয়ে গুরুত্ব


তবুও করোনাভাইরাস মহামারি যখন সারাবিশ্বে আঘাত হানলো, তখন হাই হিলকে তার মর্যাদার আসন থেকে সরে আসতেই হলো।


বাজার গবেষণা সংস্থা এনডিপি গ্রুপের ডেটা অনুযায়ী, ২০২০ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বাজারে হাই হিলের বিক্রি কমেছে ৬৫ শতাংশ। কারণ? কারণ মহামারি মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনেছে এবং মানুষ নতুন জীবনে নতুন নতুন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে। এসময় জুতা পরিধান করায় আরাম এবং নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় কোনটি সুবিধাজনক, সেদিকে প্রাধান্য দেওয়ায় হাই হিলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যায়।


এছাড়াও, রিমোট ওয়ার্কের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কর্মক্ষেত্রে পরিধানের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং অবসরযাপনে পরার পোশাকের মধ্যে পার্থক্য কমে আসে; জাকজমকপূর্ণ ইভেন্টের সংখ্যা কমে আসে, ফলে আরামদায়ক-ক্যাজুয়াল পোশাকের দিকে আগ্রহী হন ভোক্তারা।


ডা. মেয়ার সিএনএনকে বলেন, "মহামারির ফলে আমাদের অনেকেই সুস্থতা, আরাম ও বাস্তবমুখী পোশাক পরিধানকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। সামাজিকভাবে মেলামেশা এবং ফরমাল  কোনো অনুষ্ঠানে যোগদানের প্রবণতা তখন কম থাকায় এবং রিমোট ওয়ার্কের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ক্যাজুয়াল পোশাক-আনুষঙ্গিকের দিকেই বেশি ঝুকেছে।"


তারপরেও প্রশ্ন থেকেই যায়। মহামারি কি সত্যিই হাই হিলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী কোনো ভূমিকা রেখেছে? নাকি বৃহত্তর কোনো ট্রেন্ডের অংশ হিসেবে এটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে?


ডা. মেয়ার বলেন, "আমাদের সমাজ যত সমতাবাদী আদর্শের দিকে ধাবিত হচ্ছে, ততই নারীত্বকে সংজ্ঞায়িত করার ধরাবাধা বিষয়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে- আর হাই হিল তেমনই একটি অনুষঙ্গ যাকে নারীত্বের সঙ্গে যুক্ত করা হতো।"


"এ পরিবর্তন আমাদেরকে নিজ নিজ ব্যক্তিত্বকে আলিঙ্গন করতে উতসাহিত করে, ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশের ধরনে বৈচিত্র্যতা আনে এবং এমন ফুটঅয়্যারকে প্রত্যাখ্যান করে যা আমাদেরকে আরাম দেয় না এবং হাঁটাচলার গতিকে সীমাবদ্ধ করে। 


ফুটওয়্যার জগতের নতুন অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এমন একটি স্টাইল ও আরামের এমন একটি ফিউশন যেখানে দুটিই থাকবে সমানভাবে। জুতা পরিধানের ক্ষেত্রে কেডস, লোফার এবং ব্লক হিলকে বেছে নেওয়া নারীদের ফুটঅয়্যারের ল্যান্ডস্কেপই বদলে দিয়েছে।


নতুন আধুনিকতার প্রতিফলন


ভ্যালেন্তিনো, প্রেনজা শ্যুলার এবং রিক ওয়েনসের সঙ্গে ডিজাইনার কোলাবরেশনের ফলে বিরকেনস্টকের ক্লাসিক অ্যারিজোনা স্যান্ডেল যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে- মহামারিজুড়ে এটা নারীদের দৈনন্দিন ফ্যাশনের অংশ হয়ে গিয়েছিল; ২০২০ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে এই স্যান্ডেল সম্পর্কে সার্চের সংখ্যা ২২৫% বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে জানায় লিস্ট। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বিশ্লেষক মাদে লাপুয়েরতা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে 'চাংকি স্নিকার্স' এবং 'ব্ল্যাক ব্যালে ফ্ল্যাট' স্যান্ডেল নিয়ে সার্চের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৭০% ও ৭১%।


মহামারি-পরবর্তী সময়েও হাই হিলের চাহিদা তেমন বৃদ্ধি পায়নি। মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও এবং ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সার্চ ইন্টারেস্ট ১৭৭% বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও, হাই হিলের স্টাইল সম্পর্কে সার্চের পরিমাণ মহামারি-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় নিচের দিকেই ছিল। বরং এর পরিবর্তে আরামদায়ক নিচু হিল এবং ব্লক হিলের দিকেই নারীদের বেশি আগ্রহী হতে দেখা গিয়েছে।


তবে ক্রিশ্চিয় লুবুতো'র একজন মুখপাত্র ইমেইলের মাধ্যমে সিএনএনকে বলেন, "লকডাউনের সময় এবং এর পরবর্তী সময়েও হাই হিলের বেশ ভালো জনপ্রিয়তা রয়ে গেছে এবং আমাদের বিক্রির জুতার মধ্যে হিল জুতার চাহিদাও ভালো। মহামারির ফলে মানুষের জীবনযাত্রা ও ট্রেন্ডে পরিবর্তন আসায় অবশ্য হিলের মধ্যে বিভিন্ন অপশনকে বেছে নিচ্ছেন ক্রেতারা, এর মধ্যে রয়েছে প্ল্যাটফর্ম, লো হিল এবং ব্লক হিল।"


তবে অন্যান্য ব্র্যান্ডে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় তাদের ফ্ল্যাট স্যান্ডেল ও স্নিকার্সের চাহিদা আকাশছোয়া। ২০২০ সালে এখন পর্যন্ত অ্যাডিডাসের গ্যাজেল্লে স্পোর্টস শু-এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে ১৪৩% এবং 'লিস্ট সূচকে ২০২৩ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্যের তালিকা'য় শীর্ষ ১০টি পণ্যের মধ্যে চারটিই ছিল ফ্ল্যাট জুতা- অনিতসুকা টাইগার মেক্সিকো ৬৬ স্নিকার্স, নিউ ব্যালেন্স এইমি লিওন ডোর স্নিকার্স, আলাইয়া ফিশনেট ফ্ল্যাটস এবং দ্য রো সিটি ফ্লিপফ্লপ।


২০২৩ সালের শরত/শীতের ফ্যাশন শোগুলোতে ক্যাটওয়াকেও দেখা গিয়েছে ফ্ল্যাট থিমের প্রাধান্য। প্রাডা এবং বালমেই এর পয়েন্টেড ব্যালে পাম্প, মিউ মিউ ও লোয়ির লোফার, বারবেরি এবং শীতে ভ্যালেন্তিনোর বুট ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে।


এদিকে আপাতত হাই হিলকে বিদায় জানানো হয়ে গেলেও, ভবিষ্যতে এর গতিপথ কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। হাই হিল কি আবারও সদর্পে ফিরে আসবে এবং গ্ল্যামার ও আকর্ষণের প্রতীক হয়ে উঠবে?


ডা. মেয়ার বলেন, "পার্টি ও বিয়ের অনুষ্ঠানে পরতে হাই হিলের চাহিদা থাকবেই।"


তবে তিনি আরও যোগ করেন, "সৌন্দর্য্য এবং নারীত্ব নিয়ে দিন দিন মানুষের ধারণা বদলাচ্ছে; এর ফলে শারীরিক গঠন যেমনই হোক না কেন, মানুষ নিজেকে গ্রহণ করতে শিখছে, নিজের আরাম ও উপযোগিতার কথা বিবেচনা করছে, নিজেকে প্রকাশ করতে শিখছে এবং জেন্ডার সম্পর্কিত গতানুগতিক রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে।"


মহামারি যে ফ্যাশন জগতে পরিবর্তন এনেছে এবং এমন একটা যুগের সূচনা করেছে যেখানে সৌন্দর্য্য, আভিজাত্য ও আরামদায়কতা একইসঙ্গে চলতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু হাই হিল ভবিষ্যতে টিকে থাকবে নাকি হারিয়ে যাবে তা সময়ই বলে দিবে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.