আসছে মাইন্ড রিডিং যন্ত্র, কীভাবে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এতটাই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যে, আগে যেসব বিষয় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে উপস্থিত থাকত সেগুলোই এখন বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। যেমন মাইন্ড রিডিং অর্থাৎ অন্যের মন তথা মানসিক অবস্থা পড়তে পারা। এমন কিছু প্রযুক্তি এখন বাজারে আসছে যেগুলো অন্যের মানসিক অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে। আর এ বিষয়টি নীতি প্রস্তৃতকারীদের একটি কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যারা গোপনীয়তা রক্ষায় মাইন্ড রিডিং যন্ত্র নিয়ন্ত্রণে কৌশল নির্ণয়ে কাজ করছেন। 


গত ১৩ জুলাই প্যারিসে ইউনেস্কো আয়োজিত এক সভায় এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করেন স্নায়ুবিজ্ঞানী, নীতিবিদ ও বিভিন্নে দেশের মন্ত্রীরা। মাইন্ড রিডিংয়ের মতো নিউরোপ্রযুক্তি পরিচালনায় পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে তারা কথা বলেন। এটি এমন প্রযুক্তি যা সরাসরি মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত থেকে এর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ বা পরিবর্তন করতে পারে।


ইউনেস্কোর সামাজিক ও মানব বিজ্ঞানের সহকারী মহাপরিচালক গ্যাব্রিয়েলা রামোস বৈঠকে বলেন, নিউরোটেকনোলজি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি 'কোনো প্রযুক্তিগত আলোচনা নয়, এটি একটি সামাজিক আলোচনা, এটি একটি আইনি বিষয়'।


নিউরোটেকনোলজির অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে নিউরোইমেজিং কৌশল, যা মানুষের চিন্তার বিষয়বস্তুকে ডিকোড করতে পারে। এছাড়া আছে, ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই)। এই প্রযুক্তিতে মস্তিষ্ক যা হাতে লেখতে চায় সেগুলোকে টেক্সটে রূপান্তর করতে পারে। এই প্রযুক্তি এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে আছে। 


এসব প্রযুক্তি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। বৈঠকে প্রকাশিত নিউরোটেকনোলজির উপর ইউনেস্কোর সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী, ২০১৫ এবং ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিবছর দাখিল করা নিউরোটেকনোলজি-সম্পর্কিত পেটেন্টের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১০ এবং ২০২০ সালের মধ্যে এ খাতে  বিনিয়োগ ২২ গুণ বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউরোটেকনোলজি এখন ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের শিল্প।


ডিভাইস অপ্রতুল


বৈঠকে উত্তর ক্যারোলিনার ডারহামের ডিউক ইউনিভার্সিটির নীতিবিদ নীতা ফারাহানি বলেন, কোনো ব্যক্তির প্রোফাইলিংয়ের জন্য নিউরোটেকনোলজি ব্যবহার করার সম্ভাবনা এবং মানুষের চিন্তাভাবনা এবং আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে- এমন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। মস্তিস্কের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা ডিভাইসগুলো ডিজিটাল বিশ্বে এমন এক শক্তিশালী সংযোজন হবে যেখানে ইতোমধ্যে কর্পোরেট ও রাজনীতিকরা নিজেদের ফায়দার জন্যে ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করছে। 


ফারাহানি বলেন, গবেষণা সীমাবদ্ধ না করে নিউরোটেকনোলজির সম্ভাব্য ক্ষতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় এমন প্রবিধান তৈরি করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি নীতিনির্ধারকরা । চিকিৎসা এবং ভোক্তা পণ্যও স্বতন্ত্র চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে। 


চিকিৎসকায় ব্যবহৃত এধরনের পণ্যগুলো মূলত ওষুধ এবং চিকিৎসা ডিভাইসের বিদ্যমান নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ এবং সম্ভাব্য খিঁচুনি দমন করার জন্য তাদের মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে একটি ডিভাইস এখন ব্যবহার হয়। আরো উন্নত ডিভাইস আছে, যেমন বিসিআই। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিরা শুধুমাত্র তাদের চিন্তার মাধ্যমেই বিভিন্ন বাহ্যিক ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ প্রযুক্তি এখনো পরীক্ষার মধ্যে আছে। 


তবে বাণিজ্যিক ডিভাইসগুলি নীতিবিদদের বেশি চিন্তায় ফেলছে। স্টার্ট-আপ থেকে শুরু করে টেক জায়ান্ট পর্যন্ত কোম্পানিগুলো হেডসেট, ইয়ারবাড এবং রিস্টব্যান্ডের মতো পরিধানযোগ্য বহুল ব্যবহৃত ডিভাইস তৈরি করছে, যেগুলো মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করতে সক্ষম। এবং ডিভাইস নির্মাতারা এসব তথ্য পেয়ে যাবে।  


এই ক্ষেত্রের তথ্যের গোপনীয়তা একটি মূল সমস্যা। নিউ ইয়র্ক সিটির কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী রাফায়েল ইউস্টে বৈঠকে বলেন, নিউরোরাইটস ফাউন্ডেশনের একটি অপ্রকাশিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিউরোটেকনোলজি সেবা দেওয়া ১৮টি কোম্পানিতে শর্তাবলীর মধ্যে একটি হল, ভোক্তার মস্তিষ্কের তথ্যের মালিকানা কোম্পানিগুলোর হাতে থাকবে। আর একটি ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলো তৃতীয় পক্ষের কাছে সে তথ্য প্রকাশ করার অধিকার রাখে। রাফায়েল বলেন, আমি এ বিষয়টিকে বলব একধরনের লুণ্ঠন। এটি নিয়ন্ত্রণের অভাবকে প্রতিফলিত করে। 


ফারহানি বলেন, বাণিজ্যিক ডিভাইসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এসব পণ্যের সম্ভাব্য বাজার অনেক বড় এবং কোম্পানিগুলো শীঘ্রই মানুষের মস্তিষ্কের তথ্য থেকে মুনাফা করার চেষ্টা করতে পারে। 

 

নিউরোরাইটের প্রয়োজনীয়তা


বৈঠকে আরো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তা হল- কীভাবে স্নায়বিক কার্যকলাপ সংরক্ষণ এবং প্রভাবিত করার ক্ষমতা বিদ্যমান মানবাধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে। কিছু বক্তা যুক্তি দিয়েছেন যে, এই উদ্ভাবন বিদ্যমান মানবাধিকার -যেমন গোপনীয়তার অধিকার- রক্ষা করে। অন্যরা মনে করে পরিবর্তন প্রয়োজন।


দুজন গবেষক 'নিউরোরাইটস'-এর ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন। যে অধিকার পরবর্তীতে তৃতীয় পক্ষের তথ্যপ্রাপ্তী এবং একজন ব্যক্তির স্নায়ু কার্যকলাপকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হওয়া থেকে রক্ষা করবে।


জার্মানির মিউনিখের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির দার্শনিক মার্সেলো ইয়েনকা বৈঠকে বলেন, নিউরোরাইটস নেতিবাচক এবং ইতিবাচক দুই ধরনের অধিকারই হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সম্মতি ছাড়াই মস্তিষ্কের তথ্য সংগ্রহ করা হবে নেতিবাচক। আবার মানুষের মূল্যবান চিকিৎসা প্রযুক্তিতে ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রবেশ করার ক্ষমতা হবে ইতিবাচক।


রাফায়েল এবং তার সহকর্মীরা পাঁচটি প্রধান নিউরোরাইট প্রস্তাব করেছেন। সেগুলো হল- মানসিক গোপনীয়তার অধিকার; ব্যক্তিত্ব-পরিবর্তনকারী প্রভাবকের বিরুদ্ধে সুরক্ষা; ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতার সুরক্ষা; মানসিক বিকাশের ন্যায্য অনুপ্রবেশ; এবং অ্যালগরিদমের পক্ষপাত থেকে সুরক্ষা, যা নিউরোটেকনোলজির কেন্দ্রবিন্দু।


সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন


চিলি, স্পেন, স্লোভেনিয়া এবং সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ এ সংক্রান্ত নীতি তৈরি করা শুরু করেছে। প্রতিনিধিরা তাদের দেশের কাজ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করেছেন। চিলি তাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে। কারণ প্রথম দেশ হিসেবে চিলি নিউরোটেকনোলজির আইনি তত্ত্বাবধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ২০২১ সালে তাদের সংবিধানে পরিবর্তন আনে। 


চিলির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ক্যারোলিনা গাইনজা কর্টেস বলেন, তারা নতুন আইন তৈরি করছে এবং আইন প্রণেতারা প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে গবেষণার অনুমতি দেওয়ার সময় কীভাবে মানবাধিকার সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করছেন।


ইউনেস্কোর সদস্য দেশগুলো আগামী নভেম্বরে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য ভোট দেবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য যেভাবে নির্দেশিকা প্রস্তুত করেছে তেমন কিছু নিউরোটেকনোলজির ক্ষেত্রেও করা হবে কিনা সে বিষয়টি ভোটাভুটিতে চূড়ান্ত করা হবে। 


ফারাহানি বলেছেন, 'আমার আশা হল নীতিশাস্ত্রের আলোচনা থেকে আমরা বরং সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাব। নিউরোটেকলজির ক্ষেত্রে আমরা এখনো খুব বেশি দেরি করিনি। এখনো এটি সমাজে ব্যাপক প্রচলিত হয়ে ওঠেনি। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.