ওপেনহাইমারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া মনোবিদের করুণ জীবন

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ক্রিস্টোফার নোলানের সর্বশেষ সিনেমা ওপেনহাইমার-এ দর্শক যেমন পারমাণবিক বোমা তৈরির ম্যানহাটন প্রজেক্টের কর্মযজ্ঞ উপভোগ করবেন, তেমনি রবার্ট ওপেনহাইমার ও মনোবিদ জিন ট্যাটলকের জটিল রোমান্টিক সম্পর্কও দেখতে পাবেন তারা।


ওপেনহাইমারের জীবনের অন্যতম প্রভাবশালী নারী ছিলেন ট্যাটলক। সিনেমায় এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফ্লোরেন্স পিউ। তখনকার মার্কিন সমাজে নারীদের অনেক বিষয়ে অধিকার ছিল না। সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ট্যাটলক।


ট্যাটলকের অকালমৃত্যু নিয়ে আজও অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। ওপেনহাইমারের জীবনে ট্যাটলককে অনেকেই নিছক মিস্ট্রেসের ভূমিকায় দেখেন। তবে বাস্তবে ট্যাটলক-ওপেনহাইমার জুটির গল্প বেশ আলাদা।


ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলিতে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর সময় জিন ট্যাটলককে প্রথম দেখেন রবার্ট ওপেনহাইমার। ট্যাটলকের বাবা জন ট্যাটলক ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির একজন প্রখ্যাত শিক্ষক। তার সঙ্গে ওপেনহাইমারের বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল।


অন্যদিকে ২২ বছর বয়সী সবুজ চোখ আর বাদামি চুলের ট্যাটলকও ততদিনে মেডিকেল ক্যাম্পাসে বেশ জনপ্রিয় মুখ। তখন ১৯৩৬ সাল — বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো নারীর পড়তে আসাটা সেই সময় আমেরিকাতে বেশ অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। আর ট্যাটলকের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও বেশি সবার চোখে পড়ত।


কারণ জিন ট্যাটলক ছিলেন ভীষণ মেধাবী। মনঃসমীক্ষণ পড়তে ইউরোপে গিয়েছিলেন। তার ওপর ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী। তার জীবনীতে এক বন্ধু অকপটে স্বীকার করেছিলেন, 'আমরা একটু ঈর্ষা করতাম ওকে।'


ওপেনহাইমারের সঙ্গে ট্যাটলকের বয়সের ফারাক ছিল দশ বছরের। তারপরও তার বন্ধুরা সবাই একবাক্যে জানিয়েছেন, ওপেনহাইমার ট্যাটলকের প্রতি এক অভূতপূর্ব অনুরাগ অনুভব করতেন। 'রবার্ট জিনকে আর যেকোনো মানুষের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তার প্রতি একেবারে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন অপি,' বলেছেন ওপেনহাইমারে অন্তরঙ্গ বন্ধু ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী রবার্ট সার্বার।


ওপেনহাইমার কমপক্ষে দুইবার ট্যাটলককে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই তাকে ব্যর্থকাম হয়ে ফিরতে হয়।


ট্যাটলক কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এ কারণে অপি-ট্যাটলক জুটিকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। ট্যাটলকের প্ররোচনায় ওপেনহাইমার উগ্রবাদী হয়ে উঠতে পারেন, এ আশঙ্কায় এফবিআই তাদের ওপর নজরদারি চালিয়েছিল। এমনকি ট্যাটলককে সোভিয়েত স্পাই হিসেবেও মার্কিন কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করেছিল।


তরুণ বয়সে ট্যাটলক মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পরও মার্কিন সরকারের কাছে ট্যাটলকের বিরুদ্ধে থাকা এসব অভিযোগের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল ওপেনহাইমারকে।


মার্কিনীরা ট্যাটলককে নিয়ে এত বেশি সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন যে, তৎকালীন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রধান জে. এডগার হুভার ট্যাটলকের বাসার ফোনে আড়িপাতা ও তার প্রতিটি গতিবিধির ওপর নজর রাখার বন্দোবস্তও করেছিলেন।


১৯৩৯ সালে নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটনা ট্যাটলক ও ওপেনহাইমার। মাসকয়েক পরে ওপেনহাইমারের সঙ্গে ক্যাথরিন কিটি পুয়েনিংয়ের দেখা হয়। জীববিজ্ঞানী ক্যাথরিন এর আগে দুইবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। ওপেনহাইমার আর ক্যাথরিন বিয়ে করেন, তাদের ঘরে দুই সন্তান জন্ম নেয়।


কিন্তু বিয়ের পরও ওপেনহাইমার ট্যাটলকের সঙ্গে দেখা করতেন। ট্যাটলক তখন জীবনের তীব্র এক বিষণ্ণ পর্যায় দিয়ে যাচ্ছিলেন। শোনা যায়, প্রেমিকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ট্যাটলকের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।


লস আলামোসে পারমাণবিক বোমা তৈরির ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ শুরু করার পর ১৯৪৩ সালের ১৪ জুন ওপেনহাইমার ট্যাটলকের সঙ্গে সময় কাটাতে সান ফ্রান্সিসকোয় এসেছিলেন। সেবারই ট্যাটলকের সঙ্গে তার শেষ দিন ছিল।


সেদিন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ওপেনহাইমারকে তার অজ্ঞাতে অনুসরণ করেছিলেন। ট্রেন স্টেশনে ট্যাটলক-ওপেনহাইমারের দেখা হয়। দুজন দুজনকে চুমু খান। তারপর সারাদিন একসঙ্গে কাটান। সেনা কর্মকর্তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাত সাড়ে ১১টায় ট্যাটলকের বাসার আলো নিভে যায়। পরদিন সকালে দুজনে একসঙ্গে জলখাবার খাওয়ার পর ট্যাটলক ওপেনহাইমারকে গাড়িতে করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসেন।


১৯৪৪ সাল কেবল শুরু হয়েছে। কয়েকদিন ধরে বাবার ফোন ধরছেন না ট্যাটলক। ৪ জানুয়ারি বাবা মেয়ের বাসায় এসে উপস্থিত হন। জানালা বেয়ে বাসার ভেতরে ঢুকতে হয়েছিল তাকে। ঢুকেই মেয়ের লাশ দেখতে পেলেন।


অর্ধেক পূর্ণ একটি বাথটাবে ট্যাটলকের মাথাটা ডুবে ছিল। বয়স তখন কেবল ২৯। পাশেই একটা চিরকুট। সেটায় তিনি লিখেছেন, সবকিছু থেকে তার মন বিষিয়ে উঠেছে। বেঁচে থাকলে সারাজীবন বোঝা হয়ে থাকবেন — এমন আশঙ্কার কথাই প্রকাশ করেছেন নিজের সুইসাইড নোটে।


ট্যাটলক খুন হয়েছিলেন, এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দীর্ঘ নয় দশক ধরে টিকে ছিল। কিছু প্রমাণিত সত্য এ ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আরও বেশি ইন্ধন যুগিয়েছিল।


মেয়ের লাশ পাওয়ার পর ফিউনারেল সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগের আগে জন ট্যাটলক তার সঙ্গে চালাচালি করা মেয়ের সব চিঠি ও ছবি পুড়িয়ে ফেলেন। অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন, মেয়ের কমিউনিজমের সঙ্গে কোনো সন্দেহজনক যোগসূত্র যেন না পাওয়া যায়, সেজন্য এমনটা করেছিলেন বাবা।


ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, জলে শ্বাসরোধই ট্যাটলকের মৃত্যুর কারণ। আরও বলা হয়, তার রক্তে অ্যালকোহলের উপাদান পাওয়া যায়নি এবং তার নেওয়া বার্বিচুরেটগুলো মৃত্যুর সময়ে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে পৌঁছায়নি।


ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমাটি তৈরি হয়েছে আমেরিকান প্রমিথিউস শীর্ষক একটি বইয়ের ওপর ভিত্তি করে। এ বইয়ের লেখকদের কাছে ট্যাটলকের মৃত্যু বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান রাখা একজন চিকিৎসক বলেছিলেন, 'আপনি যদি স্মার্ট হন আর কাউকে মারতে চান, তাহলে এটাই সঠিক পদ্ধতি খুনের।'


ট্যাটলকের ভাই হিউ ট্যাটলকও বোনকে খুন করা হয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন।


লস আলামোসের নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা সিআইএ কর্মকর্তা পিটার ডি সিলভার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ওপেনহাইমারকে ট্যাটলকের মৃত্যুর কথা জানানোর। খবর শুনে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন ওপেনহাইমার। অফিস থেকে বেরিয়ে দীর্ঘসময় হাঁটতে চলে যান তিনি।


'আমার আর কথা বলার মতো কেউ রইল না,' মৃত্যুর খবরের প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন ওপেনহাইমার — তেমনটাই জানিয়েছেন ওই সিআইএ কর্মকর্তা।


রবার্ট ওপেনহাইমার পারমাণবিক বোমার প্রথম পরীক্ষাটির নাম দিয়েছিলেন ট্রিনিটি। তার কাছের মানুষেরা জানিয়েছেন, জন ডনের একটি কবিতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ট্রিনিটি নামটি রেখেছিলেন বিজ্ঞানী। আর ওই কবিতাটি তাকে পড়তে দিয়েছিলেন জিন ট্যাটলক।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.