সাগরের যাযাবর ওরা: যাদের কোনো রাষ্ট্র নেই!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: সুলু সাগর ফিলিপাইনকে পৃথক করেছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। বহু শতাব্দী ধরে ছোট ছোট দ্বীপ থাকা এই জলপথে এপার ওপার পাড়ি দিয়েছে বাজাও মানুষেরা। তারাই বিশ্বের একমাত্র স্বনির্ভর সাগর যাযাবর সম্প্রদায়। বাজাওরা সীমান্ত বলতে বুঝত, নৌকায় চেপে যতদূর পাড়ি দেওয়া যায়– সে দূরত্বই। 


ডুবুরির আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়াই বহুক্ষণ জলের তলে অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়ার অতুলনীয় দক্ষতা আছে বাজাওদের। এজন্য তাদের প্লীহাও (লসিকাতন্ত্র এবং রক্ত সংবহন তন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ) কালের বিবর্তনে বড় হয়ে উঠেছে। ফলে জলের নিচে ২০০ ফুট গভীরতায়- সর্বোচ্চ ১০ মিনিট থাকতে পারার রেকর্ড আছে তাদের।


দৈনিক খাদ্যতালিকায় থাকে সামুদ্রিক শসা (হলোথুরয়ডি শ্রেণীভুক্ত একটি প্রাণী)-সহ নানান রকম সামুদ্রিক প্রাণী। প্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসার কাজেও তারা এই সামুদ্রিক শসার ব্যবহার করে। এমনকি এ থেকে নেশা জাতীয় দ্রব্যও তৈরি করতে পারে।


ইতিহাসের দলিল বলে, ১৫ শতকের দিকেও ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার সাবাহ অঞ্চলের মধ্যে সাগরপথে অবাধে অভিবাসন ছিল বাজাওদের। এই জলপথের বিভিন্ন দ্বীপবাসীর সাথে তাদের সাংস্কৃতিক বিনিময় ছিল। কিন্তু, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ বাজাওদের জন্যেও এক অভিশাপ হয়ে আসে এরপর থেকেই। তাদের ঐতিহ্যবাহী সমুদ্র যাযাবরের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে– যখন উপনিবেশিক শক্তিগুলো সুলু সাগরে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার জলসীমা নির্ধারণ করে।


১৮৮৫ সনের মাদ্রিদ প্রোটোকল অনুসারে এসব সীমানা নির্ধারিত হয়। আর তখন এই অঞ্চলে বসবাসকারী নৃগোষ্ঠীগুলোর আবাস, তাদের বৈচিত্র্য – কিছুই আমলে নেওয়া হয়নি।


তবে বাজাওদের জীবনযাপনকে সবচেয়ে বেশি ব্যাহত করে মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন, ১৯৫৯/১৯৬৩। এ আইনে আশ্রয়প্রার্থী, শরণার্থী, স্বল্প-স্থায়ী অভিবাসী এবং সরকারিভাবে নথিভুক্ত নয় এমন রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।


এর ফলে জটিল এক আইনি সংকটে রয়েছে বাজাওরা। ১৯৭০ সনে ফিলিপাইনের মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে যা আরও গুরুতর রূপ নেয়। সংঘাত থেকে বাঁচতে অনেক পরিবার বোর্নিও'র পূর্ব উপকূলে চলে আসে। আর তখন থেকেই মালয়েশিয়ার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় – না নাগরিক, না রাষ্ট্রহীন– এমন দশায় রয়েছে তারা।


মালয়েশিয়ার পূর্বাঞ্চলে সেমপোর্না শহরের উপকূলে ঐতিহ্যবাহী হাউজবোটে বাস করছেন ১০০ থেকে ২০০ জন বাজাও। আইনিভাবে তাদের নেই নাগরিক হিসেবে কোনোপ্রকার স্বীকৃতি, ফলে বোর্নিও'র মূল ভূখণ্ডে ঘর বাঁধবার অধিকারও নেই। অন্যদিকে, ফিলিপাইনে বাসকারী বাজাওরা এখনও তাদের পূর্বপুরুষদেরই মতো পদ্ধতিতে সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে। নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর এভাবে শিকার করা অতিরিক্ত মাছ, চিংড়ি, সামুদ্রিক শসা তারা দ্বীপবাসীর সাথে বিনিময় করে দরকারি বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করে।


উপকূলের জলরাশির ওপর নৌকায় ঘর বেঁধেও, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাড়া করে ফিরছে তাদের। যেমন (মালয়েশিয়ার) উপকূলের জাতীয় উদ্যানে গাছ কাটায় নিষেধাজ্ঞা আছে, ফলে নৌকা মেরামতের কাঠ জোগাড় করাটা হয়ে উঠেছে কষ্টসাধ্য। এই অবস্থায় অনেকেই মূল ভুখণ্ডে বাস করার কথা ভাবছে। তবে সেখানেও তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে থাকতে হবে আশ্রয়শিবিরে। অবস্থাদৃষ্টে, মনে হচ্ছে বাজাওদের এই পরিণতি যেন অনিবার্য।  


অথচ বিপুলা সাগরের বুকে ঘর বাধা ও নির্ভয়ে পাড়ি দেওয়া বাজাওরা এক স্ব-নির্ভরশীল, গর্বিত গোষ্ঠী। যাদের আছে নিজস্ব রীতি-রেওয়াজ ঐতিহ্য। দুর্বার সাগরের সাথে লড়াই করে স্বতন্ত্র এক জীবনধারা তাদের। কিন্তু, ডাঙ্গায় নেই তাদের স্বীকৃতি। সাংবিধানিক অধিকার না থাকায়, দেশগুলোয় তারা অনাকাঙ্ক্ষিত। ফলে ডাঙ্গায় ঘর বাঁধলে থাকতে হবে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত, নিম্ন শ্রেণি হিসেবে। তাদের সন্তানেরা স্কুলে যেতে পারবে না। যুবকেরা পাবে না আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সুযোগ।


সাগরে অবাধ বিচরণ করতে পারলে, মূল ভূখণ্ডের মানুষের সাথে আগের মতো অবাধে লেনদেন করতে পারলে- এই সমস্যায় পড়তে হতো না বাজাওদের। ডাঙ্গায় ঘর বাঁধার কথাও ভাবতে হতো না। সাগরই যুগে যুগে তাদের পাঠশালা ছিল। যার বুকে বেড়ে উঠেছে তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম। প্রকৃতির শিক্ষাই যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে বড় দরকারের ছিল। কিন্তু, ডাঙ্গায় ফিরতে হলে- সাগরের জীবনশিক্ষা মূল্য পাবে না আর, তাদের অতুলনীয় জীবনধারাও হয়তো কালের পরিক্রমায় হারাতে চলেছে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.