শাড়ির বিশ্ব মাত!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: শুরুটা করেছিলেন জেনডায়া। এপ্রিলে মুম্বাইয়ের নীতা মুকেশ আম্বানি কালচারাল সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যায় ভারতীয় ডিজাইনার রাহুল মিশ্র'র ডিজাইন করা শাড়িতে। নীল রঙের শাড়ির পুরোটা জুড়ে ছিলো চুমকির কাজ, আর নিচের অংশে ফুলেল এমব্রয়ডারি। তিন হাজার ঘণ্টা ব্যয়ে তৈরী আউটফিটটি অবশ্য সার্থক, কেননা হলিউড-বলিউডের এতো এতো তারকার মাঝে সেদিন সব আলো কেড়ে নেন এই মার্কিন সুন্দরীই। 


২০২২ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে বলিউডের তারকা অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন ভারতীয় ডিজাইনার সব্যসাচী মুখার্জির কালো-সোনালি রঙা ঝা চকচকে একটি শাড়ি পরেন; কানের আসরে সেরা লুকের তালিকায় সেদিন আরও একবার ঢুকে পড়ে দীপিকার নাম।


চলতি বছর মে মাসে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ফ্যাশন ইভেন্ট 'মেট গালা'তেও দেখা মেলে শাড়ির, পরেছিলেন সুপার মডেল নাওমি ক্যাম্পবেল। যদিও নাওমির শাড়িটি পুরোপুরি শাড়ি ছিল না, একে বরং 'শাড়ি-ইনস্পায়ার্ড গাউন' বললে সঠিক হবে।



শুধুই কি ফ্যাশনের মঞ্চ, শাড়ির দেখা মেলেছে জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় অনুষ্ঠানেও। লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে রাজা চার্লসের রাজ্যাভিষেকে ব্যবসায়ী নাতাশা পুনাওয়ালা বারবেরি ব্র্যান্ডের বডিস্যুটের সাথে একটি ন্যুড রঙা ফিনফিনে শাড়ি পরে অংশ নেন।


শাড়ির জনপ্রিয়তার গল্প শেষ হয়নি- এবারই প্রথম আন্তর্জাতিক জাদুঘরে শুধুমাত্র শাড়ি নিয়ে একটি প্রদর্শনী হচ্ছে। লন্ডনের ডিজাইন মিউজিয়ামে 'দ্য অফবিট শাড়ি' নামে প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।




প্রায় তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে, উৎপত্তির সময় শাড়ি ছিল কেবল একপ্রস্থ সেলাইছাড়া কাপড়ের টুকরো। অথচ এখন এক শাড়ির ভাঁজ দেওয়া যায় শত উপায়ে। শাড়ির কুঁচি কীভাবে দিতে হয়, আঁচলটা কীভাবে বসবে তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মায়েরাই মেয়েদের শিখিয়ে এসেছেন; তবে এখন নেটমাধ্যম উপচে পড়ছে শাড়ি পরার টিউটোরিয়াল ভিডিওতে। শুধু তাই নয়, আজকাল তো আগে থেকে কুঁচি করে রাখা (প্রি-স্টিচড) শাড়িও কিনতে পাওয়া যায়। 


ভারতে সবচেয়ে বেশি যে পোশাক পরা হয়, শাড়ি তার অন্যতম। শহর কিংবা গ্রাম, সব জায়গাতেই শাড়ির উপস্থিতি বেশি। পরিধানকারীর বয়স বা দৈহিক গড়ন যেমনই হোক- শাড়ির দৈর্ঘ্য, প্রস্থে কিন্তু কোনো পার্থক্য নেই। এটি শাড়িকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পেছনে অন্যতম কারণ।


সাধারণত সুতি সিল্কের শাড়িই ভারতে সবচেয়ে বেশি চলে- আর এগুলো বেশ সাশ্রয়ীও।


তবে এখন পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শাড়ির দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৩৯ লাখ ৩১ হাজার ৬২৭ রুপি (প্রায় ১ লাখ ডলারের সমতুল্য)। দামি পাথর দিয়ে ৪৬৭০ ঘণ্টারও বেশি সময়ব্যাপী নকশা করা শাড়িটির ওজন গিয়ে ঠেকেছে ১৮ পাউন্ডে! 



ডিজাইন মিউজিয়ামের হেড অব কিউরেশন, প্রিয়া খানচান্দানির নির্বাচিত ৬০টিরও বেশি পোশাক স্থান পেয়েছে 'দ্য অফবিট শাড়ি' প্রদর্শনীতে। এতে সব্যসাচী মুখার্জি এবং অমিত আগরওয়ালের মতো নামী ভারতীয় ডিজাইনারদের কাজের পাশাপাশি তাঁতিদের নকশাও রয়েছে। শুধু অলংকরণের ক্ষেত্রেই নয়, নারীর ক্ষমতায়ন এবং অ্যাক্টিভিজমের প্রতীক হিসেবেও শাড়ি যে কতো প্রভাবশালী তাও এ প্রদর্শনীর লক্ষ্য। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এসে দক্ষিণ এশীয় নারীরা ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির ধারক এই পোশাকটি নিয়ে কেমন নিরীক্ষা করছেন, সেটিও এখানে ফুটে এসেছে।


শাড়ি আবার হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষাও। উত্তর ভারতের 'গুলাবি গ্যাং'য়ের কথাই ধরা যাক- পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সময় গোলাপি রঙের শাড়ি পরেছিলেন এর সদস্যরা।


সাম্প্রতিককালে নতুন প্রজন্মের অনেকেই শাড়িতে ভিন্নভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে আলোচনায় এনেছেন। দিল্লির এষনা কুট্টি নামক একজন নৃত্যশিল্পীর শাড়ি পরে হুলা হুপ ঘোরানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভারতের এ সময়ের আরেক 'ইনস্টাগ্রাম সেনসেশন' উরফি জাভেদ আবার প্রায়ই শাড়িতে নিজেকে বিচিত্রভাবে উপস্থাপন করে আলোচনার জন্ম দেন।   


নবরূপে শাড়ি


'দ্য অফবিট শাড়ি' নামে প্রদর্শনীটি শাড়ির বুননের সাথে ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির বিষয়ে আলোকপাত করে। সিল্ক, কটন বা পলিয়েস্টার এখনও মানুষ দিব্যি পরছে তবে ভারতের আধুনিক ডিজাইনাররা সূক্ষ্ম মেটাল থ্রেডের মতো উপাদানও এখন শাড়ি তৈরির প্রক্রিয়ায় যুক্ত করছেন। এতে অনেক পুরনো আমলের শাড়িও নতুন রূপ পাচ্ছে।  



সব সময় ভিনদেশি তারকারা যে শাড়ি পরে প্রশংসাই কুড়িয়েছেন, তা নয়। অনেকে সমালোচিতও হয়েছেন। ১৯৮৮ সালের ভিএইচওয়ান ভোগ ফ্যাশন অ্যাওয়ার্ড শোতে ম্যাডোনার সাজ যেমন ভালো লাগেনি অনেকের কাছেই। ২০১১ সালে ভারতীয় ডিজাইনার তরুণ তাহিলিয়ানির সাদা শাড়িতে লেডি গাগার এবং ২০১৮ সালে জয়পুরে ছুটি কাটাতে এসে ডুয়া লিপার 'শাড়ি লুক'ও অনেকের মনঃপূত হয়নি। অবশ্য সোয়ারোভস্কি ক্রিস্টালসে ঘেরা গাগার শাড়িটি ডিজাইন মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে ঠিকই স্থান পেয়েছে এবার।



শাড়িতে ম্যাডোনাকে মনে ধরেনি ভক্তদের

'দ্য গ্রে এরিয়া বিটুইন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন অ্যান্ড অ্যাপ্রেসিয়েশন' শীর্ষক এক লেখায় ভোগ ইন্ডিয়া আমেরিকান অভিনেত্রী এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক সারাহ জেসিকা পার্কারের সমালোচনা করে। কারণটা হলো, ২০২২ সালে জনপ্রিয় 'সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি'র স্পিন-অফ সিরিজ 'অ্যান্ড জাস্ট লাইক দ্যাট' এর 'দিওয়ালি' এপিসোডে সারাহকে লেহেঙ্গা পরতে দেখা গেলেও, সিরিজে একে তিনি শাড়ি হিসেবে পরিচয় দেন! 


একইভাবে, নব্বইয়ের দশকে টিপ এবং শাড়ি পরায় বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন মার্কিন গায়িকা গোয়েন স্টেফানি। যদিও অনেক বছর পর, ২০২২ সালে নিউইয়র্কের রকফেলার সেন্টারে ক্রিসমাস প্রগ্রামে স্টেফানি শাড়ি পরে বেশ প্রশংসা কুড়ান।  মুম্বাইয়ের ডিজাইনার অমিত আগরওয়ালের প্রি-স্টিচড শাড়িতে তাকে দেখে ভারতের পুরো ফ্যাশন কম্যুনিটি স্বাগত জানায়।


সিএনএনকে অমিত বলেন, "স্টেফানিকে আমাদের আউটফিটে দেখতে পাওয়াটা ছিল অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক।" 


"এটি বিশাল প্ল্যাটফর্মে আমাদের কারিগরদের (ক্রাফটসমেন) কাজ এবং সৃজনশীল কৌশল প্রদর্শনের সুযোগ দিয়েছে।" 




ভারতের এ ডিজাইনার মনে করেন, শাড়ি ইতিমধ্যেই একটি আন্তর্জাতিক পোশাক হয়ে উঠেছে। এটি আর ভৌগোলিক সীমা-পরিসীমা কিংবা কোন নির্দিষ্ট রীতিতে আটকে নেই। 


"শাড়িতে কোনো 'অফবিট' কিংবা 'এক্সোটিক' ব্যাপারই থাকা উচিত নয়, এটি মূলধারার (মেইনস্ট্রিম) অন্তর্গত। ভৌগলিক সীমার ঊর্ধ্বে অন্যান্য সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান গ্রহণ করার ব্যাপারটা সত্যিই দারুণ", বলেন অমিত।


আরেক তরুণ ডিজাইনার রিমঝিম দাদুও এ কথায় সম্মত। রিমঝিমের ভাষ্যে, "নিরীক্ষা করা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। হাজার হাজার বছর আগে কোনো এক ব্যক্তি পাঁচ গজ কাপড় নিয়ে নিরীক্ষা করেছিল বলেই তো আমরা শাড়ির মতো পোশাক পেলাম। এত বছরে পোশাকটি বারবার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। শাড়ির জন্য তাই নিরীক্ষা এবং সংরক্ষণ দুটোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।" 


অনুপ্রেরণার ইতিহাস


নৃবিজ্ঞানী ড. ফিলিডা জে তার 'ইনস্পায়ারড বাই ইন্ডিয়া' বইয়ে উল্লেখ করেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফরাসী কুতোরিয়ে মাদাম গ্রে কিংবা জ্যঁ পল গতিয়ে থেকে লেবানিজ ডিজাইনার এলি সাব প্রত্যেকে ঐতিহাসিকভাবে এই পরিচ্ছদটি থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।


লন্ডনের 'লাক্সারি শপিং ডিস্ট্রিক্ট' হিসেবে পরিচিত মেফেয়ারে ভারতীয় রিটেইল ব্র্যান্ড 'পার্নিয়া'র দোকানে ভারতের প্রায় ৫০ জন ডিজাইনারের কালেকশন জমা আছে। এর স্বত্বাধিকারী অভিষেক আগরওয়াল সিএনএনকে বলেন, তার এই দোকান থেকে শুধু যে প্রবাসী ভারতীয়রাই শাড়ি কিনছেন তা নয়, বরং এর ক্রেতারা ছড়িয়ে আছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।



তিনি বলেন, "সবসময় আমাদের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় ফ্যাশনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং একে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম প্রদান করা।"


ব্যস্ত সড়ক, ফ্যাশন ইভেন্টের রেড কার্পেট, লন্ডনের গ্যালারি বা প্যারিসের ক্যাটওয়াক যেখানেই বলা হোক- শাড়ি কেবলই বিস্তৃত হচ্ছে।


দিল্লির টেক্সটাইল ডিজাইনার গৌরব জয় গুপ্ত ইমেইল বার্তায় সিএনএনকে বলেছেন, "ভারতের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির সাথে এর সাংস্কৃতিক কলাকৌশলও মানুষ গ্রহণ করবে। আমি চাই, বিশ্বজুড়ে আরও বহু মানুষ শাড়ি পরুক।"


তার এ ইচ্ছা পূরণ হবে কি-না, তাতো সময়ই বলবে।  

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.