কোন গান জনপ্রিয় হবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে এআই? পারবে, ৯৭ ভাগ নির্ভুলভাবে: গবেষণা

 


ODD বাংলা ডেস্ক: সকল সংগীতশিল্পীই নিজের গানকে জনপ্রিয় করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তবে অ্যাপল মিউজিক কিংবা স্পটিফাইয়ের মতো বিখ্যাত মিউজিক প্ল্যাটফর্মে খুব কম গানই হিটের তকমা পায়। এমনকি শতাংশের হিসেবে মাত্র ৪ ভাগ নতুন গান এইসব প্ল্যাটফর্মের চার্টে জায়গা করে নিতে পারে।


নতুন প্রকাশিত একটি গান চার্টের শীর্ষে অবস্থান করবে কি-না, সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় ঠিক কোন গানগুলো জনপ্রিয় হতে পারে, সেটি বোঝার একটি মেথড বের করেছেন গবেষকরা।


এক্ষেত্রে মেশিন লার্নিং ও এআই ইন্টেলিজেন্স টেকনিক শ্রোতাদের মস্তিষ্কে প্রয়োগ করা হয়। এতে করে একটি গান শোনার সময় শ্রোতার মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়াগুলো রেকর্ড করা হয়। ফলে ঠিক কোন গানগুলো ব্যক্তির আবেগ জাগিয়ে তুলছে পারছে, সেটিও শনাক্ত করা যায়। পরবর্তীতে দেখা যায়, যেই গানগুলো ব্যক্তির আবেগকে বেশি জাগিয়ে তুলতে পারছে, সেই গানগুলোই সাধারণত জনপ্রিয়।


লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্লারেমন্ট গ্র্যাজুয়েট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা মূলত এমনি একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। ফ্রন্টিয়ার্স ইন আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়েছে।


গবেষণায় মানুষের নিউরোফিজিওলজিকাল প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণের জন্য স্মার্টওয়াচেও রয়েছে এমন প্রচলিত সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে।  


গবেষণায় মোট ৩৩ জন শ্রোতাকে একটি স্ট্রিমিং সার্ভিসের পক্ষ থেকে মোট ২৪ টি নির্ধারিত গান শোনানো হয়। এই গানগুলোর মধ্যে ১৩ টি জনপ্রিয় গান ছিল; যা প্ল্যাটফর্মটিতে কমপক্ষে ৭ লাখ বার স্ট্রিম হয়েছে। আর বাকি গানগুলো ততটা জনপ্রিয় ছিল না। 


গানগুলো শোনানোর পর প্রতিটি গানের জন্য গবেষকেরা মনোযোগ সংশ্লিষ্ট মস্তিষ্কের সংকেত (ডোপামিন নিঃসরণের সাথে যুক্ত) এবং মানসিক প্রতিক্রিয়ার সংকেত (অক্সিটোসিনের সাথে যুক্ত) পর্যালোচনা করেন। মস্তিষ্কের এই সংকেতগুলি উদ্দীপনার পরে সৃষ্ট আচরণের সঠিক পূর্বাভাস দিতে সক্ষম। বিশেষ করে আবেগীয় প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।


সহজভাবে বলতে গেলে, রেকর্ড করা সংকেতগুলো মনের একটি জানালা হিসেবে কাজ করে। এই জানালাটিই শ্রোতাদের মস্তিষ্কে প্রতিটি গানের ভিন্নধর্মী প্রভাব বিশ্লেষণে গবেষকদের সহায়তা করেছে।


ক্লারেমন্ট গ্রাজুয়েট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ও গবেষণাটির প্রধান লেখক পল জ্যাক গবেষণার এই পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, "এমনটা মনে হতে পারে যে, শুধু ছন্দ বা সুরের মতো বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে একজন ব্যক্তি একটি গান পছন্দ করেন। কিন্তু নিজের সহজাত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একজন ব্যক্তির পুরোপুরি জানা সম্ভব নয়। তবে ব্যক্তি তা সনাক্ত করতে না পারলেও অচেতন মস্তিষ্কের সিস্টেমগুলি ঠিকই জানে যে, কোনটি তার কাছে ভালো কিংবা মন্দ।"


গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, শ্রোতাদের নিউরোফিজিওলজিকাল প্রতিক্রিয়া যে গানগুলি জনপ্রিয় ছিল তা অনুমান করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে লিনিয়ার স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল ব্যবহার করে ৬৯ ভাগ জনপ্রিয় গান শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আর মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষকেরা ৯৭ ভাগ পর্যন্ত জনপ্রিয় গান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।


গবেষণায় সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেলেও দলটি বেশ কয়েকটি সীমাবদ্ধতার কথাও স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে গবেষণায় নমুনা হিসেবে খুবই কম সংখ্যক গান ব্যবহার করা হয়েছে। একইসাথে গবেষণায় অংশগ্রহণ করা শ্রোতাদের ভৌগলিক বৈচিত্র্য ততটা ছিল না।


তবে যে মেথডলজিতে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে, সেটি বিনোদন জগতের নানা পরিসরে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন সিনেমা কিংবা টিভি শো এর ক্ষেত্রে এটি 'গেইম চেঞ্জার' হিসেবে কাজ করতে পারে। 


এক্ষেত্রে ভিন্নধর্মী কন্টেন্টের গবেষণার ক্ষেত্রে ডেটাকে হয়তো ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু নিউরোফিজিওলজিকাল প্রতিক্রিয়া একই থাকবে। 


এ সম্পর্কে পল জ্যাক বলেন, "গবেষণায় ব্যবহার করা মেথডলজিটি বেশ উপযোগী। অর্থাৎ, এটি বারবার ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও প্রতিটি মডেল কিছুটা ভিন্নধর্মী হবে।"


একটি গান রিকমেন্ড করার ক্ষেত্রে স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলো আবার তাদের নিজস্ব মডেল ব্যবহার করে। তবে সেটি গবেষণায় ব্যবহার করা মেথডলজির মতো নয়। বরং সেক্ষেত্রে অ্যালগরিদম, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ, শ্রোতাদের আচরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিবেচনায় আনা হয়।


এ সম্পর্কে স্পটিফাইয়ের দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপের হেড অফ মিউজিক মেলানিয়া পারেজো জানান, একটি গানের ক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মগুলোকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর বিবেচনা করতে হয়। অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে স্ট্রিমিং সংখ্যা, গানের গ্রোথ রেট ইত্যাদি। আর বাহ্যিক ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে রয়েছে, গানটিকে নিয়ে অনলাইন ও টেলিভিশনে যা চলছে সেই ব্যাপারগুলো।


মার্কিন গবেষকদের জনপ্রিয় গানের ভবিষ্যদ্বাণী নির্ধারণের মেথডটি ঠিক কতটা কার্যকরী হবে, সেটি এখনই বলা কঠিন। তবে অনেকেই মনে করছেন, মেথডটি ব্যবহার করে যথাযথ গান বানানো সম্ভব।


প্রফেসর জ্যাক মনে করেন, মেথডটি মূলত গান তৈরিতে কাজে আসতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সঙ্গীতশিল্পী কিংবা ব্যান্ডগুলোকে আগে মূল গানটি বানাতে হবে। তারপর একদল শ্রোতাকে গানটি শুনিয়ে মেথডটি ব্যবহার করে তাদের আবেগীয় প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করা হবে। তারপর সেইসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গানের সুর, লয়, তালে প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তন আনা যেতে পারে।


এ বিষয়ে প্রফেসর জ্যাক বলেন, "ইতিমধ্যেই এই পদ্ধতিটি কিছু গান তৈরিতে ব্যবহার করছে। তবে একদম শুন্য থেকে মডেলটির ওপর ভিত্তি করে কোনো জনপ্রিয় গান বানানো সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। প্রথমে শিল্পীকে অবশ্যই প্রাথমিক সৃজনশীল যে কাজ, সেটি করতে হবে।"


অন্যদিকে অধ্যাপক সের্গি জর্ডা ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গান ও প্রযুক্তির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনিও মনে করেন যে, সেন্সর ব্যবহার করে মস্তিষ্কের সংকেত বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি গান তৈরি সহজ হতে পারে। তবে বর্তমানে এটি জনপ্রিয় গান তৈরি করতে সক্ষম হবে; এমনটা মানতে নারাজ তিনি। কিন্তু তিনি এও বলেন যে, জেনারেটিভ এআই এবং মুড সেন্সরের দ্রুত অগ্রগতির ফলে সুদূর ভবিষ্যতে সেটা সম্ভব হতেও পারে। অর্থাৎ, মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ভবিষ্যতে চার্টের শীর্ষে অবস্থান করবে এমন সব জনপ্রিয় গান তৈরি করা যেতে পারে।


মিউজিক বিজনেস ওয়ার্ল্ডওয়াইডের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত চীনা স্ট্রিমিং জায়ান্ট টেনসেন্ট মিউজিক এন্টারটেইনমেন্ট এআই জেনারেটেড ভয়েসের মাধ্যমে মানুষের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে এক হাজারেরও বেশি গান তৈরি ও প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে 'টুডে' নামে এআই জেনারেটেড ভয়েজের একটি গান প্রথমবারের মতো ১০০ মিলিয়ন বার স্ট্রিম হয়েছে।


প্রফেসর জ্যাক মনে করেন, তার দলের গবেষণা মেথডটি একজন শিল্পীকে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে। তিনি বলেন, "আপনি যদি ব্রিটিশ রক ব্যান্ড 'দ্য রোলিং স্টোনস' হয়ে থাকেন কিংবা আপনার যদি প্রায় হাজার হাজার কনসার্টে গান গাইবার অভিজ্ঞতা থেকে থাকে, তবে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। সেক্ষেত্রে আপনি ইতিমধ্যেই জানেন যে, কোন মিউজিক ভালো আর কোনটা খারাপ।"


কিন্তু একজন অনভিজ্ঞ সঙ্গীতশিল্পী বুঝতে নাও পারেন যে, তার কোন গান শ্রোতা পছন্দ করবে আর কোনগুলো পছন্দ করবে না। এ বিষয়ে প্রফেসর জ্যাক বলেন, "একটি গান শুধু শিল্পের কথা মাথায় রেখেই বানানো হয় না। বরং একজন শিল্পীকে এমন সব গান তৈরি করতে হবে যা কেবল শিল্পিকেই নয় বরং শ্রোতাদের আবেগও জাগিয়ে তোলে, অন্যদের স্পর্শ করতে পারে।"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.