বিজ্ঞাপনের ছবির সঙ্গে কেন বাস্তবের বার্গারের মিল থাকে না?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: দক্ষিণ লন্ডনের বাসিন্দা ক্রিস একজন বার্গারপ্রেমী। বাড়িতে ফেরার পথে দেরি হলে কখনো কখনো তিনি বার্গার কিনে নেন, আর নাহয় বাচ্চাদের নিয়ে রাতের খাবারের জন্যও বার্গার কেনেন। আবার মাঝেমধ্যে ঝটপট পেট ভরানোর জন্যও বার্গারের ওপরই ভরসা করেন তিনি।


তবে একইসঙ্গে ক্রিস খেয়াল করেছেন- বন্ধুবান্ধব এবং তার পরিচিত আরও যারা বার্গারপ্রেমী আছেন, তাদেরকে প্রায়ই তিনি নিজের বার্গারের ছবি পাঠান এবং অপর প্রান্তের ব্যক্তিরা সেই ছবি দেখে হেসে কুটিকুটি হন। এর কারণ, বিজ্ঞাপনে বার্গারগুলোকে যেভাবে দেখানো হয় তার সঙ্গে বাস্তবের বার্গারের বিশাল পার্থক্য।


"বেশিরভাগ সময়ই বার্গারগুলো দেখে মনে হয় যেন কেউ এগুলোর উপর বসে পড়েছিল!" বলেন ক্রিস।


তাই ক্রিস যখন শুনলেন যুক্তরাষ্ট্রে বার্গার কিং এর ক্রেতারা প্রতিষ্ঠানটিকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে গেছে, তখন তার মাথায়ও একটা চিন্তা খেলে গেল। ৪২ বছর বয়সী ক্রিস বলেন, "আপনার মনে হবে আপনার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। কিন্তু কে-ই বা সেই বার্গার ফেরত নিয়ে গিয়ে অভিযোগ করে বিব্রত হতে চাইবে? তাই নীরবে শুধু খেয়ে ফেলে।" 


জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান বার্গার কিং দাবি করেছে, তারা যেসব বার্গার বিক্রি করে সেগুলোতে দেখতে 'হুবহু তাদের বিজ্ঞাপনে দেওয়া ছবির মতো' এবং 'যুক্তরাজ্যের সর্বত্র ক্রেতাদের সেই একই বার্গার পরিবেশন করা হয়'।


কিন্তু বার্গার কিনে খাওয়ার সময় একথা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অসন্তুষ্ট ক্রেতারা আরও একটি উদাহরণ দিয়েছেন: আইসক্রিমের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় যে আইসক্রিমে আমন্ড বাদাম ভরপুর, কিন্তু বাস্তবে পাওয়া যায় সামান্য কিছু বাদামকুচি। পিজ্জার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, উপরে অল্পকিছু টপিং; সালাদের দাম আকাশছোঁয়া কিন্তু সেখানেও থাকে পর্যাপ্ত উপকরণের অভাব।


চিজ পুল


নিউইয়র্ক ও ফিলাডেলফিয়া-ভিত্তিক ফুড স্টাইলিং কোম্পানি অ্যাস্টির-এর প্রধান অ্যামি ওয়ার্ডল বলেন, যৌক্তিক নিয়ম এটাই যে আপনার পণ্যে যেসব উপকরণ থাকবে না, বিজ্ঞাপনেও সেগুলো দেখানো যাবে না।


কিন্তু সেখানেও ক্রেতাকে বিভ্রান্তিমূলকভাবে প্রলুদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে।


ক্রিসের ভাষ্যে, বেশিরভাগ সময়ই বার্গারগুলো দেখে মনে হয় কেউ এগুলোর উপর বসে পড়েছিল। ছবি: ক্রিস/বিবিসি

আপনি যদি রুটির বিজ্ঞাপন দিতে চান তাহলে স্লাইসের মাঝে স্পঞ্জ রেখে এটাকে আরও পরিপূর্ণ দেখাতে পারেন, বলে ওয়ার্ডল। এক স্লাইস পিজ্জায় যথেষ্ট পরিমাণের 'চিজ পুল' দেখানোর জন্য আপনাকে হয়তো বাড়তি পনির যোগ করতে হতে পারে। সিরিয়ালের বোল দেখানো যেতে পারে এক বোল গ্লু ব্যবহার করে, এতে করে দুধ ব্যবহারে চাইতে ভেজা ভাব কম বোঝা যায়।


বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখানো বার্গারের বান (গোলাকার রুটি) যাতে মেয়োনিজের জন্য পিছলে সরে না যায় সেজন্য টুথপিক দিয়ে আটকানো থাকে। "কিন্তু আমি এমন কিছু ব্যবহার করবো না যা মেকি। দরকার হলে কয়েক ডজন বানের মধ্য থেকে খুঁজে এমন দুটো বান বের করবো যেগুলো কুঁচকানো বা ঝুরঝুরে খসে পড়ার মতো নয়। আমি ছোট কাঁচি ব্যবহার করে বানের চারপাশে একদম মসৃণ করে ফেলবো, যাতে করে একটুও গুড়া না বোঝা যায়", বলেন ওয়ার্ডল।


"এরপরে সবচেয়ে ভালো, সতেজ লেটুস পাতা খুঁজে বের করবো যার মধ্যে একটুও দাগ থাকবে না, নেতিয়ে পড়বে না। আর টমেটোর ক্ষেত্রেও সবচেয়ে লাল টমেটোই বেছে নিবো", যোগ করেন তিনি।


ওয়ার্ডল জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বার্গার কিং এর 'হপার' বার্গার নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তিনি এর সঙ্গে একমত যে: বার্গারটির বিজ্ঞাপনের ছবি দেখে মনে হয় বানের চাইতে প্যাটি বড়।


তবে এমনও হতে পারে আপনি দোকান থেকে যে বার্গার কিনেছেন তা র‌্যাপিং করা ও হিট ল্যাম্পের নিচে রাখার ফলে এবং প্যাকেট করে আপনার হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কিছুটা চ্যাপ্টা হয়ে যায়- বলেন ওয়ার্ডল।


আবার এমনও হতে পারে যে তারা আসলেই মাংসের প্যাটির তুলনায় ছোট বান ব্যবহার করেছে। তাই চাপ লেগে প্যাটিটা সামনের দিকে চলে আসে এবং আরও ছড়িয়ে যায়।


কিন্তু ওয়ার্ডল জানান, তিনি যদি এই বার্গারের ফুড স্টাইলিং করতেন তাহলে তিনি প্যাটির পেছনের দিকে কেটে এটাকে ছড়িয়ে দিতেন।


মিথ্যা প্রশংসা বা অতিরঞ্জিত করা


ইউনিভার্সিটি অব বাফালো-এর আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক মার্ক বার্থোলমেউ বলেন, প্রচারণার জন্য এ ধরনের কৌশল ব্যবহারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই যুক্তরাষ্ট্রে, যতক্ষণ না পর্যন্ত ছবিটি ওই পণ্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে।


কিন্তু এখানেও একটা ফাঁক রয়ে যায়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "বিজ্ঞাপনদাতারা ভাবেন যে ক্রেতারা এটুকু বুঝতেই পারবে যে বিজ্ঞাপনে তাদের পণ্যকে কিছুটা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে।" 


"এখানে মূল কথা হচ্ছে: কেউ যখন টাকা দিয়ে বার্গার কিনে খাচ্ছে, তাকে কি আসলেই বোকা বানানো হচ্ছে? কেউ কি আসলেই ধরে নিয়েছে যে বিজ্ঞাপনে দেখানো হপার বার্গারই সে পাবে?" বলেন এই অধ্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মামলাতে বার্গার কিং যুক্তি দেখাতে পারে যে, কেউই আসলে ধরে নেয় না যে পোস্টারে দেখানো বার্গারের মতো হুবহু সে পাবে।


বিচারকও ইতোমধ্যেই বার্গার কিং এর বিজ্ঞাপনের মামলার নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন, শুধুমাত্র দোকানে থাকা বার্গারের ছবি নিয়ে অভিযোগ করা যাবে, জানান বার্থোলোমেউ। 


একথা সবারই জানা যে, বিজ্ঞাপন মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এবং অতিরঞ্জিত করেই দেখানো হয় সবকিছু। কিন্তু দোকানে আপনি মেন্যুতে যা দেখছেন, অর্ডার করে ঠিক তেমনই পাচ্ছেন কিনা সেটাই হবে আদালতে আলোচনার বিষয়। বার্থোলোমেউ জানান, বিজ্ঞাপনে পণ্যের ভুল উপস্থাপন নিয়ে এযাবত যেসব মামলা করা হয়েছে, তার মধ্যে খুব কম মামলাই সফলতার মুখ দেখেছে। কারণ এসব মামলা একেকজন ব্যক্তির নিজস্ব অনুভূতি, মতামতের ভিত্তিতে দায়ের করা হয়। আর ইউএস ফেডারেল ট্রেড কমিশন এ ধরনের মামলাতে জড়ায় না বললেই চলে।


তবে যুক্তরাজ্যে আইন একটু কঠিন হলেও এর অন্তর্নিহিত নীতি আসলে একই: প্রচারণার উদ্দেশ্যে প্রকাশিত ছবিতে পণ্যকে ভুল বা বিভ্রান্তিমূলকভাবে উপস্থাপন করা যাবে না।


"দোকানের মেন্যু বাদে, বাইরে প্রমোশনাল ইমেজ বা প্রচারণামূলক ছবি প্রকাশ বিষয়ক নিয়মনীতি বজায় রাখা হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব  অ্যাডভারটাইজিং স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি'র (এএসএ)", বলেন এর মুখপাত্র টোবি কিং।


ছোট হাত 


বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বাস্তবে পণ্যের বৈসাদৃশ্য নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, তাহলে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এটা প্রমাণ করা যে তাদের ছবিতেও আসল পণ্যকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।


"আমরা জানি যে ভোক্তারা খুবই জ্ঞানসম্পন্ন। তারা বোঝে যে বিজ্ঞাপনে যা দেখানো হচ্ছে সেটাই বাস্তবতা নয়। কিন্তু এই দুটির মাঝেও একটা সীমারেখা আছে, আমাদের বুঝতে হবে সেই সীমারেখা পেরিয়ে যাচ্ছে কিনা", বলেন টোবি কিং।


অতীতে ২০০৫ সালে এএসএ কেএফসির একটি বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। তারা তাদের কর্মীদের মিনি ফিলে চিকেন বার্গার কিনতে পাঠিয়েছিল এটা বোঝার জন্য যে বাস্তবে বার্গারটা কত বড়। কিং এর ভাষ্যে, "ওইসময় কেএফসি বলেছিল যে মডেলের হাতগুলোই ছোট ছিল।"


২০১০ সালে বার্গার কিং এরও একটি বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়; এবারই সেই একই- বার্গারের আকার নিয়ে অভিযোগ।


তবে এরপরেও দক্ষিণ লন্ডনের বাসিন্দা ক্রিস যে বার্গার কেনা বন্ধ করবেন না তা নিশ্চিত। বরং তিনি ওইসব দোকান থেকেই বার্গার কিনবেন যারা সত্যিকার ছবি প্রকাশ করে তাদের বিজ্ঞাপনে। "বার্গারকে আসলে ওভাবে উপস্থাপন করার দরকারও নেই যেন এগুলো মাধ্যকর্ষণ শক্তির বিপরীতে! প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তাদের সত্যিকার পণ্য নিয়ে গর্বিত থাকা।"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.