সোশ্যাল মিডিয়ায় 'লাইক' পাওয়ার নেশা: কেন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: দুটি ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে যেখানে গ্রাহকদের 'ব্যবহারকারী' হিসেবে অভিহিত করা হয়: অবৈধ মাদক এবং সফটওয়্যার শিল্প। নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্র 'দ্য সোশ্যাল ডিলেমা'তে বলা হয়েছে এ কথাটি। 'লাইক' বাটনের মতো তাৎক্ষণিক পুরস্কারের ব্যবস্থার মাধ্যমে ডোপামিন হরমোনকে হাতিয়ার করে মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেখানে। যখন একজন ব্যবহারকারী (ইউজার) তার পোস্টে প্রচুর লাইক পান তখন ডোপামিন নিঃসৃত হয়; যখন তাদের মনে হয় তারা পুরস্কৃত হচ্ছেন, লোকে তাদের প্রশংসা করছে, তখন এর আকর্ষণে তারা আটকে যান।  


এই লাইক বাটনের স্রষ্টা হলেন প্রোডাক্টিভিটি অ্যাপ্লিকেশন 'আসানা'র সহ-প্রতিষ্ঠাতা জাস্টিন রোজেনস্টাইন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, রোজেনস্টাইন নিজেই এখন আর 'লাইক' বাটন পছন্দ করেন না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, "আমি ভেবেছিলাম মানুষ যা পছন্দ করে সেই অনুভূতি খুব সহজে প্রকাশ করার মাধ্যম হবে 'লাইক' বাটন। আমি সেই ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এটাকে সহজ-সাদামাটা রাখতে চেয়েছিলাম, সেই চিন্তা থেকেই 'লাইক' বাটনের এরকম আকৃতি দেওয়া হয়েছে।


কিন্তু এখন ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে 'ডিজলাইক' বাটন, বিষয়টা খুবই অদ্ভুত কারণ এর আসল উদ্দেশ্যই এখন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ এই প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্দেশ্যই ছিল এমন একটা অবকাঠামো ডিজাইন ও প্রচার করা যেখানে মানুষ একে-অপরকে সহযোগিতার জন্য একটা জগত তৈরি করবে।"


'লাইক' বাটনের বিবর্তন: প্রশংসা থেকে শুরু করে অর্থ উপার্জন


ফেসবুক সর্বপ্রথম 'লাইক' বাটনের সঙ্গে নেটিজেনদের পরিচয় করিয়ে দেয় ২০০৯ সালে; তখন থাম্বস-আপ এর মাধ্যমে লাইক দেওয়া হতো। এই প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য ওয়েবসাইটকেও একই ধরনের লাইক বাটন ব্যবহারের অনুমতি দেয় যাতে করে ব্যবহারকারীরা ফেসবুক প্রোফাইলে নিজেদের আগ্রহের জায়গাগুলো শেয়ার করতে পারে এবং এর মাধ্যমে ফেসবুক নিজেদের সাইটের বাইরের মানুষদের অনুভূতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য নিতে পারে। এর উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরও প্রত্যক্ষভাবে তাদেরকে টার্গেট করা।


২০১৫ সালে মাইক্রো ব্লগিং সাইট টুইটারে গিয়ে এই লাইক বাটন হয়ে গেল 'লাভ' আকৃতির; আবার ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটকেও লাইক বাটন 'লাভ' আকৃতির। বর্তমানে একই ধরনের 'লাভ' আকৃতির লাইক বাটন হিঞ্জ'র মতো ডেটিং অ্যাপগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১১ সালে ইনস্টাগ্রামে স্ক্রিনে দুইবার ট্যাপ করেই 'লাইক' দেওয়ার সুযোগ ছিল ব্যবহারকারীদের- যা সোশ্যাল মিডিয়ায় সংযোগ স্থাপন এবং দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি করেছে: "আপনি কিছু একটা দেখলেন, লাইক দিলেন এবং স্ক্রল করতে থাকলেন।"


শুরুর দিকে কারো পোস্টে লাইক দেওয়া মানে বোঝাতো 'আমি এটা দেখেছি', কিন্তু সময়ের সাথে সাথে 'কে কত বেশি লাইক পাবে'র একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়ে গেছে; তাও শুধুমাত্র বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই নয়, বরং অপরিচিত যারা শুধুমাত্র আপনাকে লাইকই দেয় না, ফলোও করে। 


"যখন কেউ নিজের প্রোফাইল দিয়ে একটা বড় ফলোয়ার বেজ তৈরি করে ফেলেছে বলে ভাবে তখন মনে হয়, হাজার হাজার এমনকি লাখ লাখ মানুষ তাকে ফলো করে কারণ তাদের ওই ইউজারকে ভালো লাগে, তারা তার প্রশংসা করে। কিন্তু সবসময় সেটা সত্যি নয়। ব্যবহারকারীরা হয়তো লাইকের মাধ্যমে বোঝাচ্ছে যে আপনি যেই ছবি বা ভিডিও শেয়ার করেছেন সেটা তাদের ভালো লেগেছে। একই কারণে আরও হাজারখানেক মানুষকে তারা যেমন ফলো করে, আপনাকেও করে।


'লাইক' পাওয়ার এই নেশার কারণে নেটিজেনদের অনেকেই প্রচুর টাকা খরচ করে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ফলোয়ার ও লাইক কিনতে চায়। তাদের ধারণা এতে তাদের প্রোফাইল অনেক সমৃদ্ধ হবে এবং এগিয়ে যাবে; একই ধারণার ভিত্তিতে তারা আসল ফলোয়ার ও লাইক পাওয়ারও চেষ্টা করে।


আমরা এতই অদ্ভুত যে কারো প্রোফাইলে ফলোয়ার কম থাকলে বা পোস্টে লাইক কম থাকলে আমরা সেই প্রোফাইলকে গুরুত্ব দেই না; অন্যদিকে প্রচুর ফলোয়ার এবং লাইক দেখলে আমরা সেই প্রোফাইল ঘুরে দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠি এবং নিজেরাও ফলো দেই, যেহেতু অনেকেই এই প্রোফাইল ফলো করে... বিষয়টা হয়তো মজার বটে! আর এভাবেই বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর প্রোফাইল সমৃদ্ধ হয়", বলেন ডিজিটাল মার্কেটিং ও সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞ ফাতিমা মার্তিনেজ লোপেজ।


'লাইক' বাটনের বিপদ!


"একটি সম্প্রদায়ের জন্য তৈরি 'লাইক' বাটনকে এখন নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। "আমি মনে করি লাইক বাটন যদি মানুষকে নিয়ন্ত্রণের একটা টুল নাও হয়, তবুও এটা এমন একটা টুল যা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের প্রভাবিত করে। ভুলভাবে হলেও, এই লাইক সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন মানুষ কেমন তা পরিমাপের উপায় হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, এটা একটা নকল 'হ্যাপি পিল', বা সন্তুষ্টিলাভের উপায় 'লাইক'। আমার কাছে অচেনা মানুষের থেকে ১০০,০০০ লাইক পাওয়ার চেয়ে দুঃসময়ে একজন বন্ধুকে কাছে পাওয়ার গুরুত্ব বেশি,"  বলেন মনোবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিতে আসক্তি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ মার্ক ম্যাসিপ।


"'লাইক' পাওয়ার প্রতিযোগিতার পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। একইসঙ্গে এটি একটি 'ফলস স্ট্যাটাস' তৈরি করে যে, যার যত বেশি ফলোয়ার ও লাইক রয়েছে সেই ব্যক্তি তত উচ্চ পর্যায়ের। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা মানুষকে ডি-ভার্চুয়ালাইজ করে ফেলছি, মানুষের আবেগীয় দিকটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। কারণ আপনার কাছে অগণিত লাইক থাকলেও, বাস্তবে যখন একজন মানুষকে পাশে পাওয়া যাবে না তখন ওই লাইকের কোনো মূল্যই নেই", যোগ করেন তিনি। 


'লাইক' এর ব্যবহার খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা কম আসেন তারা এই নেশার ফাঁদে পা নাও দিতে পারেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সক্রিয় ব্যবহারকারীদের জন্য। "এসব ক্ষেত্রে এই নেশা এড়িয়ে যাওয়া খুব কঠিন, কারণ আমরা সাধারণত নিজের সমকক্ষ অন্যদের সঙ্গে তুলনা করি এবং এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব দেখা যায়। অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে পারসোনাল ব্র্যান্ডিংয়ে এবং নিজের পেশায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। কারণ 'লাইক' যত বেশি হবে, আপনার কন্টেন্ট তত বেশি দৃশ্যমান হবে এবং পেশাগত ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার ও স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে।


আরেকটি পয়েন্ট হলো, ব্যবহারকারীরা জানেন যে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচুর টাকা আয় করা যায়। ফলোয়ার যত বেশি হবে, আপনার প্রোফাইল তত বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এর ফলে এজেন্সি ও কোম্পানিগুলো আপনাকেই নিবে তাদের পণ্যের প্রচারণার জন্য বা তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য। নিজের অহম, ব্যক্তিগত বা পেশাদার অবস্থান এবং টাকা উপার্জনের সম্ভাবনার এক নিখুঁত মিশ্রণ হলো 'লাইক' পাওয়ার এই নেশা", বলেন মার্তিনেজ লোপেজ।


ইগোন'স হেলথ অ্যান্ড লাইফস্টাইল স্টাডি'র জরিপে দেখা গেছে, ৪৪% মানুষ বিশ্বাস করে যে 'ব্যক্তির আবেগীয় স্বাস্থ্যের ওপর সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক বা খুবই নেটিভ প্রভাব রয়েছে'। যদিও এতে মোটেই অবাক হচ্ছেন না লোপেজ। "নিঃসন্দেহে 'লাইক' পাওয়ার একটা আবেগীয় প্রভাব রয়েছে এবং এটা ব্যক্তিকে 'বৈধতা প্রদানের' একটা টুলের মতো হয়ে গেছে যা নেশায় পরিণত হতে পারে", বলেন তিনি।


"প্রচুর প্রাপ্তবয়স্ক লোক, তরুণ এবং টিনেজার, এমনকি শিশুরাও প্রতিনিয়ত মোটাদাগে এই লাইক-ফলোয়ার্সের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হওয়ার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে, কারণ তাদের একটা 'স্বীকৃতি' দরকার। কারো কারো কাছে এটা এতই প্রয়োজন যে তারা বেশি লাইক পাওয়ার জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি", যোগ করেন তিনি।


সোশ্যাল মিডিয়া কনসালটেন্ট সের্হিও মোগান ব্যাখ্যা করে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমরা নিজেদের প্রোফাইলে যা করি তা শেয়ার করার সত্যিই কোনো দরকার আছে কি? যদি এমনটা করিও, এর কারণ আমরা অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে চাই বা মতামত চাই। বর্তমানে 'লাইক' হয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় 'বৈধতা' পাওয়ার প্রতীক। কারো যদি লাইক বেশি থাকে তার মূল্যও বেশি এবং আমরা দেখেছি যে লাইক বেশি থাকলে এই প্ল্যাটফর্মে সফলতা পাওয়ার সুযোগও বেশি।"


সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে 'লাইক' এর প্রভাব


'লাইক' শুধু যে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের ওপর প্রভাব ফেলে তা-ই নয়, এটি জুটিদের মধ্যেও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। 'লাইক' দেওয়া থেকে অন্যের প্রতি হিংসা বা ভীতির উদ্রেক হয় এবং এটাকে অন্যের প্রতি আকর্ষণও ধরে নেন অনেকে।


আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্কগুলোতে কিভাবে লাইকের মাধ্যমে বৈধতা পাওয়ার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়? সের্হিও মোগান বলেন, "১৫ সেকেন্ডেরও কম সময়ের ভিডিও, ১০ সেকেন্ডের কম সময়ে টুইট এবং তিন সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই ইনস্টাগ্রামের ছবিতে লাইক দেওয়া আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। সেই জগত থেকে বেরিয়ে বন্ধুবান্ধবের সাথে ঘুরতে যাওয়া, মানুষের সঙ্গে মেশা, সিনেমা দেখতে যাওয়া বা বই পড়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে আমাদের জন্য। আমার পরামর্শ হলো, আপনি যদি এগুলোর কোনোটা করা বাদ দিয়ে দেন অথবা সোশ্যাল মিডিয়া দেখতে দেখতেই এগুলো করেন, তাহলে আপনার উচিত কিছুদিন বিরতি নেওয়া, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা এবং সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।


বিশেষজ্ঞরা যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত তা হলো- সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা এমন একটা জগতে আছি বলে ভান করতে পারি যেটা বাস্তব নয়। "অনেক অসুখী মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে সুখী হিসেবে দেখায়, আবার বাস্তবে নিজের কাছে একটা ইউরোও না থাকলেও বিলাসবহুল হোটেল বা গাড়িতে ঠিকই ভিডিও করে দেখানো যাচ্ছে, পোশাক ভাড়া নিয়ে ছবি তুলে আবার ফেরত দেওয়া যাচ্ছে দোকানে এবং একটা 'মিথ্যা ইমেজ' তৈরি করা হচ্ছে যা অন্যদের প্রশংসার বা ঈর্ষার কারণ হতে পারে। অ্যানালগ ও ডিজিটাল জগত, দুই জায়গায়ই এমন মানুষ আছেন যারা সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করছেন লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য, আবার অনেকেই এমন মেকি ইমেজ তৈরি করছেন", বলেন ফাতিমা মার্তিনেজ লোপেজ।


অন্যদিকে, মনোবিজ্ঞানী মার্ক ম্যাসিপ জানান, তার কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হলো- বাস্তবে আমরা কী এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করছি বা লোকের কাছে কী ইমেজ 'বিক্রির চেষ্টা' করছি। "এখান থেকে হতাশার জন্ম হয়, যার সাথে যুক্ত হয় আসক্তি ও ডিপ্রেশন", বলেন তিনি।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.