থ্রি-হুইলারের ব্যাটারি, এক বছরের জায়গায় টিকবে ৩-৫ বছর, দুই হার্ভার্ড স্নাতকের সমাধান!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার এখন দেশের কোটি কোটি যাত্রীর স্থানীয় পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। 


এই যানবাহনগুলো চলে লেড-অ্যাসিড ব্যাটারিতে। এ ব্যাটারি সম্পূর্ণ রিচার্জ হতে সাত থেকে আট ঘণ্টা সময় নেয়। চার্জ হতে এত সময় লাগায় বাহনগুলো চালানোর সময় পাওয়া যায় কম। এর ফলে চালকের উপার্জনও কমে যায়। চালকরা তাদের বাহনের ব্যাটারি প্রায়ই ফাস্ট চার্জিং করেন। এর ফলে এসব ব্যাটারির সেবা দেওয়ার আয়ু যায় কমে। এছাড়া ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাটের ফলে চালকদের দুশ্চিন্তাও বেড়ে যায়।


দীর্ঘ সময় নেওয়া ছাড়াও অনানুষ্ঠানিক চার্জিং ব্যবস্থা সরকারের জন্যও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অনেক গ্যারেজ অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করে, যার ফলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ আয় থেকে বঞ্চিত হয়।


তবে এসব গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করার প্রক্রিয়া অচিরেই বদলে যেতে পারে। কেননা টাইগার নিউ এনার্জি (টএনই) নামে একটি কোম্পানি থ্রি-হুইলারের জন্য ব্যাটারি সোয়াপিং স্টেশন স্থাপনের জন্য কাজ করছে।


এই স্টেশনগুলো মূলত ব্যাটারির চার্জিং ক্যাবিনেট। এসব স্টেশন স্থাপন করা হবে থ্রি-হুইলার গ্যারেজে। চালকরা তাদের চার্জ ফুরিয়ে যাওয়া ব্যাটারিগুলো এখানে দিয়ে রিচার্জ করা ব্যাটারি নিতে পারবেন। ব্যাটারিগুলো লিথিয়ামের—এবং লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির চেয়ে অনেক হালকা। এর ফলে ব্যাটারির অদলবদল সহজ হবে।


কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা দুই হার্ভার্ড স্নাতক বলছেন, কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এসব সোয়াপিং স্টেশন জাতীয় গ্রিড থেকে যেন বিদ্যুৎ চুরি না হয়, তা নিশ্চিত করবে। এর ফলে সরকারের একটি বড় উদ্বেগ দূর হবে।


টাইগার নিউ এনার্জির সিইও নিকোল মাও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে উদীয়মান বাজারে টেকসই গতিশীলতার বিপ্লব ঘটানো। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার দুটোই আমাদের সমাধানের অংশ। হার্ডওয়্যার অংশে আমাদের প্রধান পণ্য হলো ব্যাটারি। এটিই আমাদের প্রযুক্তির মূল অংশ। ব্যাটারির সুবিধা কাজে লাগিয়ে আমরা ব্যাটারি সোয়াপিং স্টেশন স্থাপন করছি। এর ফলে রিকশাচালকদের মতো ব্যবহারকারীদের আর দামি ব্যাটারি কেনার দরকার পড়বে না।'


নিকোল আরও বলেন, 'বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থিতিশীল না থাকলেও ব্যাটারি রিচার্জ করা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না ব্যবহারকারীদের। তারা যতক্ষণ খুশি যানবাহন চালাতে পারবেন, ব্যাটারির চার্জ কমে এলে স্টেশনে এসে সেটির বদলে নতুন একটি ব্যাটারি নিয়ে যেতে পারবেন। কাজেই চালকরা লম্বা সময় কাজ করতে পারবেন এবং বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন।'


টিএনই তাদের সোয়াপিং স্টেশনগুলোতে এলএফপি ব্যাটারি (লিথিয়াম ফেরোফসফেট) ব্যবহার করবে, যার শক্তির ঘনত্ব প্রচলিত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির চেয়ে অনেক বেশি।  এলএফপি ব্যাটারি ব্যয়বহুল হলেও, এর আয়ুষ্কাল দীর্ঘ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খরচ পুষিয়ে যায়। এভাবেই টিএনই কম খরচে সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এতে থ্রি-হুইলার মালিকদের আয় আরও বাড়বে।


পেশায় ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, টিএনইর চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) ইওয়েই ঝু বলেন, 'লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি মাত্র ছয় থেকে আট মাস টেকে, যেখানে লিথিয়াম ব্যাটারি তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। তাই লিথিয়াম ব্যাটারির দাম বেশি হলেও, আয়ুষ্কালের বিবেচনায় এ ব্যাটারির ইউনিট মূল্য কমই পড়ে।'


ইওয়েই ও নিকোল দুজনেই হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করেছেন। সেখানেই তাদের প্রথম দেখা। ইওয়েই মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিরিয়াং ডিগ্রি লাভ করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আলিবাবা গ্রুপের প্রডাক্ট ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।


অন্যদিকে নিকোল কানাডার ইউনিভার্সিটি অভ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে স্নাতক এবং হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল থেকে পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। হার্ভার্ডের আগে নিকোল বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপে (বিসিজি) ব্যবস্থাপনা পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন।


চীনে নিকোলের পরিবারের ৩০ বছরের পুরোনো পারিবারিক ব্যাটারি ব্যবসা আছে। তাদের আন্তর্জাতিক সংযোগ বেশ শক্তিশালী। 


 মোটরসাইকেল, গাড়ি এবং আইপিএস ও জেনারেটরের মতো বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের জন্য মেইনটেন্যান্স-ফ্রি লেড-অ্যাসিড ব্যাটারিও বিক্রি করছে টিএনই। তবে সোয়াপিং স্টেশনগুলোর জন্য কোম্পানিটি শুধু লিথিয়ামের ব্যাটারি ব্যবহার করবে।


আগে থেকেই উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন থাকায় টিএনই থ্রি-হুইলার ব্যাটারির বাজারে মৌলিক পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করার আত্মবিশ্বাস পেয়েছে। আগেও এই পরিবর্তন আনার চিন্তা ও আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কেউ বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি।


 চীন ও ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য স্থানে এ প্রযুক্তি বেশ আগে থেকেই প্রচলিত আছে। নতুন কিছু দেখলে মানুষ প্রায়ই অস্বস্তিতে পড়ে, কিন্তু একবার তারা আইডিয়াটি বুঝতে পারলে সেটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে বলে আমরা বেশ আত্মবিশ্বাসী। সেজন্যই আমরা এখানকার কাজে না লাগানো সম্ভাবনাগুলোর সদ্ব্যবহার করার জন্য নেতৃত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।'


একগুচ্ছ অত্যাধুনিক ও চমৎকার প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হবে সোয়াপিং স্টেশন। ব্যবহারকারীরা 'টাচ অ্যান্ড গো' কার্ড দিয়ে সোয়াপিং মেশিন ব্যবহার করতে পারবেন। কার্ডের টাকা শেষ হয়ে গেলে গ্যারেজ থেকেই রিফিল করিয়ে নিতে পারবেন। ব্যাটারি বদলে নিতে সময় লাগবে মাত্র এক মিনিট। সোয়াপিং স্টেশন করা হবে গ্যারেজে। গ্যারেজ মালিক হবেন ফ্র্যাঞ্চাইজি পার্টনার। ওই পার্টনার অ্যাপের মাধ্যমে স্মার্টফোনে বিদ্যুৎ খরচ থেকে তার আয় পর্যন্ত সবকিছু দেখতে পারবেন। 


সোয়াপিং স্টেশনে তাপমাত্রা সেন্সর থাকে। তাই ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলে সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হওয়া বন্ধ করে দেবে। ফলে আগুন লাগার ঝুঁকি থাকবে না। তারপরও যদি দুর্ঘটনাক্রমে আগুনে লেগে যায়, সেজন্য ইন-বিল্ট অ্যারোসল ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেমও রয়েছে স্টেশনে।


সিস্টেমে ব্যবহৃত ব্যাটারি রিচার্জ হতে সময় লাগে  কম। ইওয়েই জানান, ব্যাটারির চার্জ ৩০ শতাংশ থাকলে সেটি ৮০ শতাংশে উন্নীত করতে সময় লাগে মাত্র ২৫ মিনিট।


ইওয়েই বলেন, 'গাড়ির ব্যাটারির মতোই এ ব্যাটারির চার্জও ৮০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ হতে সাধারণত বেশি সময় লাগে। ব্যাটারি সোয়াপিং স্টেশন আমরা উচ্চ দক্ষতায় চালাতে চাই। তাই স্টেশন এমনভাবে স্থাপন করি, যাতে ব্যাটারি ৮০ শতাংশ চার্জ হয়ে গেলেই সেটি যেন ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তবে স্টেশন যদি পর্যাপ্ত সময় পায়, তাহলে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত চার্জ করা সম্ভব।'


টিএনই দুই ধরনের ব্যাটারি ব্যবহার করছে: রিকশার জন্য ৪৮ ভোল্টের, অপরটি ইজি বাইক নামে পরিচিত বড় থ্রি-হুইলারে ব্যবহৃত ৬০ ভোল্টের। বড়টির ওজন প্রায় ১৮ কেজি।


ব্যাটারি ও স্টেশনে জিপিএস এম্বেড করা থাকে। তাই ব্যাটারি চুরি হয়ে গেলে ফ্র্যাঞ্চাইজি পার্টনাররা সেটি খুঁজে বের করতে পারবেন।


টিএনই এখন সারা দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি পার্টনারদের নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ করছে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি।


কোম্পানিটির হেড অভ কমিউনিকেশন কেবিএম নাসিরুজ্জামান বলেন, 'কাজ চলছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা পার্টনার পেয়ে যাব। রাজশাহী, নড়াইল, ফেনীসহ সারা দেশ থেকে প্রচুর আগ্রহী পার্টি আসছে আমাদের কাছে। এই তালিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে। সোয়াপিং স্টেশন স্থাপন করা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।'


আমরা জানতে চেয়েছিলাম, বাজার কত বড়? 


ইওয়েই বললেন, 'এই মুহূর্তে প্রায় ৩ মিলিয়ন রিকশা বা ইজিবাইক চালক আছেন। তাই একটি স্টেশন যদি প্রায় ১৫ জন ব্যবহারকারীকে সেবা দেয়, তাহলে মোট ২ লাখ ব্যাটারি সোয়াপিং স্টেশন লাগবে।'


বাজারে তাদের মতো আরও কোম্পানির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কি না, জানতে চাইলে ইওয়েই বলেন, এ কাজের জন্য শুধু টাইগার নিউ এনার্জির ওপর নির্ভর করলেই চলবে না। তাই তারা আরও অংশীদারকে স্বাগতই জানাবেন। 'অন্যদের জন্যও জায়গা আছে। তাদেরকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে উৎসাহিত করছি, তবে আমরা অন্যদের নিয়ে চিন্তিত নই।'

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.