আমরা কেন ৯টা-৫টা কাজ করি? ৮ ঘন্টা কর্মদিবস কিভাবে এলো
ODD বাংলা ডেস্ক: 'প্রতিদিন ৯টা থেকে ৫টা কাজের ছকে বাঁধা জীবন', কথাটা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। কর্মস্থলে এই ধরাবাঁধা রুটিনের কারণে জীবনে একঘেয়েমি চলে আসার অভিযোগও করেন কেউ কেউ। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্কৃতিতেও সপ্তাহে পাঁচ দিন, আট ঘণ্টা কর্মদিবসের নিয়ম- যে সময়সূচিকে মার্কিন গায়িকা ডলি পার্টন তার ১৯৮০ সালের 'নাইন টু ফাইভ' গানের মাধ্যমে অমর করে রেখেছেন।
অনেকেই ধরে নেন ৯টা-৫টা কাজ করাই হয়তো স্বাভাবিক নিয়ম, এমনই হয়তো সবসময় ছিল। কিন্তু না, শুরু থেকেই এই নিয়ম প্রচলিত ছিল না। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস বাস্তবায়ন শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে আট ঘণ্টা কর্মদিবস প্রবর্তন কোনো একটি ইউনিয়ন বা শিল্প, একটি কোম্পানি বা একটি আইনের ফলাফল নয়। বরং বহু বছর ধরে শ্রমিক ধর্মঘট, জনসমর্থন, রাজনৈতিক সমঝোতা, কতিপয় নিয়োগকর্তাদের অগ্রগামী ভূমিকা পালন এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার মতো বিষয়গুলোর জটিল সমন্বয়ের ফলে অবশেষে এই মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে।
মার্কিন সমাজে কিভাবে দিনে আট ঘণ্টা কর্মদিবস প্রবর্তিত হলো এবং পরবর্তীতে তা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও গৃহীত হলো তা এখানে খুবই সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ও অর্থনীতির ইতিহাসবিদ বেঞ্জামিন হুনিকাট বলেন, সাধারণভাবে বলতে গেলে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৮০০'র দশক থেকেই কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য আস্তে আস্তে কমে আসছিল এবং ১৯২০'র দশকে তা অনেকটাই কমে যায়।
ওয়েক ফরেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ রবার্ট ওয়াপলস ইকোনমিক হিস্টোরি অ্যাসোসিয়েশন-এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে 'কর্মঘণ্টা'র বিবর্তন নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তার ভাষ্যমতে, ১৮০০'র দশকের মাঝামাঝি সময়ে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টার বেশি কাজ করা ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। সাধারণত মানুষ তখন সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতো; অর্থাৎ দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করতো তারা।
তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও মানুষের এর চেয়ে বেশি সময় কাজ করার উদাহরণ যে নেই, তা নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে, ইস্পাত শিল্পে ব্লাস্ট ফার্নেস কর্মীরা সাধারণত এক সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টাও কাজ করতো বলে জানান ওয়াপলস।
"শ্রমিকদের দিয়ে এই অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় কাজ করানোর তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছিল তখন; এবং ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ধর্মঘটের একটি মূল বিষয় ছিল এটি। যদিও সেই ধর্মঘট ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু এর চার বছর পর ইউএস স্টিল কোম্পানি তাদের দৈনিক কর্মঘণ্টা ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় নিয়ে আসে", বলে হোয়াপলস।
১৯২৬ সালে হেনরি ফোর্ডের নেতৃত্বে ফোর্ড মোটর কোম্পানি সপ্তাহে ৫ দিন ৮ ঘণ্টা করে কাজের নিয়ম প্রবর্তন করে। এরপরে ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দার সময়কালে (যা গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিত) যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে যায় এবং এসময় ছয় ঘণ্টা কাজের প্রস্তাবটি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।
হুনিকাট তার লেখা বই 'কেলগ'স সিক্স-আওয়ার ডে'তে লিখেছেন কিভাবে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেলগ'স ১৯৩০ সালে শ্রমিকদের বেতন কিছুটা কমিয়ে, আট ঘণ্টার শিফটের পরিবর্তে ছয়-ঘন্টার শিফট চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
এ পদক্ষেপের ফলে কেলোগ তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের পুনরায় নিয়োগ এবং আরও নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে সক্ষম হয়েছিল। তবে কেলোগ'স-এর প্রতিষ্ঠাতা উইল কেইথ কেলগের অন্য একটি বিষয় দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে, কর্মীদের আগেভাগে ছুটি দিলে তা বৃহত্তর অর্থে তাদের জন্যই মঙ্গল। হুনিকাট জানান, কর্মীরা আগে আট ঘণ্টায় যা উপার্জন করতো, পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তারা ছয় ঘণ্টায় একই উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।
কেলগ'স-এর এই উদ্যোগ জাতীয় পর্যায়ে সাড়া ফেলে এবং শীঘ্রই ছয় ঘণ্টায় কর্মদিবস নির্ধারণের জন্য ফেডারেল আইন প্রণয়নের জোর দাবি আসে। কিন্তু সাময়িকভাবে ৩০ ঘণ্টায় কর্মসপ্তাহ প্রচলনের জন্য একটি বিল সিনেটে পাশ হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে প্রস্তাবটি পাশ হয়নি।
১৯৩৩ সালে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডেলানো রুজভেল্ট 'ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিকভারি অ্যাক্ট (এনআইআরএ)-এ স্বাক্ষর করেন, যার আওতায় নিয়োগকর্তারা ৩৫-৪০ ঘণ্টায় এক কর্মসপ্তাহ প্রচলনের এবং সপ্তাহে ন্যূনতম ১২ ডলার থেকে ১৫ ডলার মজুরি দিতে চুক্তিবদ্ধ হন; যদিও এর দুই বছর পর সুপ্রিম কোর্ট এই আইনকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে।
এনআইআরএ-কে অবৈধ ঘোষণার পরেও আইনপ্রণেতা এবং ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৩০'র দশকের শেষের দিকে এমন কিছু তৈরি করেন যা বর্তমানে সারা বিশ্বজুড়ে প্রচলিত- যেটিকে আমরা এখন 'সপ্তাহে ৫ কর্মদিবসে এবং ৮ ঘণ্টা কাজের আইন' বলে জানি। একইসঙ্গে ন্যূনতম মজুরি এবং শিশুশ্রম প্রতিরোধের আইনও প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৩৮ সালে ফ্রাংকলিন ডি. রুজভেল্ট 'ফেয়ার লেবার স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাক্ট'-এ স্বাক্ষর করেন; যে আইনে বলা হয়েছে যে কর্মীরা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে নিয়োগকর্তা তাদেরকে ওভারটাইম (বাড়তি পারিশ্রমিক) দিতে বাধ্য।
কেলগের প্রতিষ্ঠিত ৬ ঘণ্টায় কর্মদিবসের রীতি কর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও, তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫০'র দশকের শেষের দিকে অধিকাংশ কর্মীই দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যারা এর ব্যতিক্রম ছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী। তারা ১৯৮০'র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৬ ঘন্টা কাজের রুটিনেই অভ্যস্ত ছিলেন।
অধ্যাপক হুনিকাট কেলগের কিছু কর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন যে কেন তারা ৮ ঘণ্টা কাজের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। জবাবে কর্মীরা জানিয়েছেন, কম সময় কাজ করার চাইতে অর্থের প্রয়োজনই তাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা চাকরিতে কম সময় দিয়ে কম অর্থ পেতে আগ্রহী নন।
"বেশি অর্থের প্রয়োজনেই তারা এ পথ বেছে নিয়েছেন। অবসর সময় কাটানোর মূল্য তাদের কাছে কমে গিয়েছে, উন্নতির অংশ হিসেবে এটা আর যায় না", বলেন হুনিকাট।
তবে বর্তমান যুগেও কর্মজীবীদের জন্য অর্থ ও সময়ের মধ্যে এই লেনদেন একইভাবে প্রাসঙ্গিক, তবে এখানে যুক্ত হয়েছে নতুন টুইস্ট। জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন- পরিবারকে সময় দেওয়া; সেই তুলনায় কাজের পেছনে কতটুকু সময় দেওয়া উচিত- সে ব্যাপারে মানুষের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন এনেছে করোনাভাইরাস মহামারি।
আরও অনেক শ্রম অধিকার বিশেষজ্ঞের মতো হুনিকাটও ভাবেন- জেনারেশন জেড এবং 'মিলেনিয়াল কর্মী'রাও কি কর্মক্ষেত্রে তাদের আগের প্রজন্মগুলোর চাইতে ভিন্ন কোনো কর্মপন্থাকে বেছে নেবে?
"মহামারির অভিজ্ঞতা মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এনেছে। হয়তো একইসঙ্গে জীবনকে সম্পূর্ণ উপভোগ করার এবং কর্মক্ষেত্রেও দায়িত্ব পালনের একটা উপায় রয়েছে। এটা আবারও আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে", বলেন হুনিকাট।
Post a Comment