মহালয়ার সকালে তর্পণ কেন করা হয়, তর্পণ করতে কী কী লাগে, জেনে নিন


ODD বাংলা ডেস্ক: আপনারা অনেকেই তর্পণ শব্দটির সাথে কম বেশি পরিচিত। মহালয়ার দিন তর্পনের জন্য প্রসিদ্ধ বিবেচিত। এসময় প্রয়াত পুর্বপুরুষের আত্মা সর্বনিম্ন স্তরে অর্থাৎ পৃথিবীর খুব কাছে বিরাজ করে। এসময় যদি তর্পন করা হয় তবে তর্পণের উদ্দেশ্য সফল হয়।

তর্পন কাকে বলে ?
তর্পণ ” শব্দটি এসেছে “ত্রুপ” থেকে। “ত্রুপ” কথার মানে “সন্তুষ্ট করা”। ঈশ্বর, ঋষি ও পুর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশে জল নিবেদন করে তাদের সন্তুষ্ট করাকে তর্পন বলা হয়। শাস্ত্রোক্ত মতে কার্য্য দ্বারা অপরের তৃপ্তি হয়, তাহাই তর্পন (অপরের প্রীতার্থে জল দান) ।

তর্পনের উদ্দেশ্য  কী বা কেন করতে হয় ?
তর্পণের সময় ঈশ্বর, পুর্বপুরুষের আত্মার নাম উচ্চারন পুর্বক তাদের কাছে সুখ শান্তি কামনা করা হয়। মানুষ জীবন রক্ষার্থে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রাণীয়াদি হিংসা করে বধ করে থাকে। এছাড়াও অন্যান্য অপকর্মের দরুন শাস্ত্রমতে পাপগ্রস্থ হতে হয়। এই পাপ মোচনার্থে সনাতন শাস্ত্র মতে তর্পণ করিতে হয় ।

তর্পন মন্ত্র অর্থঃ- ব্রক্ষা হইতে তৃণ শিখা পর্যন্ত সমস্ত জীব জগৎ মদ্দত্ত জল দ্বারা তৃপ্ত হউক, এই প্রার্থনা ।

বিদ্রঃ- পিতা-মাতা জীবিত থাকা কালিন প্রেত তর্পন ভিন্ন অন্য তর্পণ করতে নেই। তর্পন করিবার পূর্বে জল শুদ্ধি করিবেন ও উক্ত জলে কুরুক্ষেত্রের মন্ত্র পাঠ করিয়া শুদ্ধি করিবেন। এই জিল দিয়ে তর্পণের কাজ করবেন।

তর্পণ করতে কী কী লাগে ?
- কুশিতে কুরুক্ষেত্র মন্ত্র পাঠের জল, চন্দন, তিল, তুলসী পত্র ওঁ ত্রিপত্রী দিয়ে তর্পন করতে হয়।
জেনে রাখুন, পিতৃ ও মাতৃ তর্পনের সময় জল, তিল,চন্দন, তুলসী পত্র ওঁ ত্রিপত্রী আর অন্যন্য তর্পনের সময় তিলের পরিবর্তে ধান্য বা যব লাগবে।চন্দন, তিল, যব না থাকলে কুরুক্ষেত্র মন্ত্র পাঠের জলে তুলসী পত্র দিয়ে তর্পণ করবেন।

তিল তর্পনঃ
তিল তর্পণ মানে জল ও তিল একসাথে করে পুর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশে নিবেদন করতে হবে। পিতৃতর্পণের সময় অবশ্যই তিল ব্যবহার করতে হবে। তিল ২ রকম- সাদা ও কালো তিল। শ্রদ্ধার সময় কালো তিল ব্যবহার করা উচিত। যত জনের জন্য শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে প্রত্যেকের উদ্দেশে আলাদা আলাদা করে তিল অর্পন করতে হবে। তিল না থাকিলে শুধু কুরুক্ষেত্র মন্ত্র পাঠের জলে তুলসীপাতা দিয়ে তির্পন করিতে পারিবেন ।

তিল তর্পন করার উদ্দেশ্যঃ
তিল ব্যবহারের মাধ্যমে নেতিবাচক ও আসুরিক শক্তি শ্রাদ্ধকারির মাঝে প্রবেশ করতে পারেনা। শ্রাদ্ধের দিন ঘরে তিল ছিটিয়ে দিতে হয়। জলের সঙ্গে তিল মিশিয়ে শ্রাদ্ধে আগত ব্রাহ্মণদের খেতে দিতে হয়। শ্রাদ্ধ শেষে তিল ডান করতে হয়।

তর্পণ প্রকার :
১) পিতৃ তর্পণ 
২)মাতৃ তর্পণ 
৩) গুরু তর্পণ 
৪) ঋষি তর্পণ 
৫) দিব্য পিতৃতর্পণ  ।
৬) যম তর্পণ 
৭) ভীষ্ম তর্পণ 
৮) বাম তর্পণ 
৯)লক্ষণ তর্পণ ।
১০) শূদ্র তর্পণ 

"মৃত্যুর পর পরলোকে জীবের গতি"
মৃত্যুর পর পরলোকে জীবের গতির দুটি প্রধান পথের কথা শাস্ত্রে বলা আছে। (১) দেবযান বা উত্তরমার্গ, (২) পিতৃযান বা দক্ষিণমার্গ। সগুণ ব্রহ্মের উপাসক, নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থী ও পঞ্চাগ্নির জ্ঞানসম্পন্ন গৃহস্থরা মৃত্যুর পর দেবযান বা উত্তরমার্গে যান। প্রথমে এঁরা অগ্নিলোকে যান, তার পরে শুক্ল পক্ষ, ছয় মাস উত্তরায়ণ, দেবতা, বায়ু, সূর্য প্রভৃতি বিভিন্ন লোক ভ্রমণ করে সব শেষে ব্রহ্মলোকে বা সত্যলোকে উপস্থিত হন। সেখানে আত্মজ্ঞান পেয়ে মুক্তি লাভ করেন। তাঁদেরকে আর সংসারে ফিরে আসতে হয় না। এর নাম ক্রমমুক্তি।

আর যে সব গৃহস্থ সংসারে থেকে অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ এবং ঈষ্ট পূজা ও অন্যান্য পূণ্যকর্মের অনুষ্ঠান করেন তাঁরা পিতৃযান বা দক্ষিণমার্গে যান এবং পরে চন্দ্রলোকে উপস্থিত হন। সেখানে তাঁরা পূর্বজন্মের পূণ্যকর্মের ফল ভোগ করেন। ভোগশেষে সমস্ত পূণ্যকর্ম শেষ হলে আবার এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই ভাবে তাঁরা সংসারে বার বার যাতায়াত করেন।

তর্পণ কখন করা হয়:
জীবিত ব্যক্তির পিতা বা পিতামহ যে তিথিতে মারা যান, পিতৃপক্ষের সেই তিথিতে তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। পূর্ববর্তী বছরে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ হয় চতুর্থী (চৌথা ভরণী) বা পঞ্চমী (ভরণী পঞ্চমী) তিথিতে। সধবা নারীর মৃত্যু হলে, তাঁর শ্রাদ্ধ হয় নবমী (অবিধবা নবমী) তিথিতে। বিপত্নীক ব্যক্তি ব্রাহ্মণী নারীদের শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করেন। শিশু বা সন্ন্যাসীর শ্রাদ্ধ হয় চতুর্দশী (ঘট চতুর্দশী) তিথিতে। অস্ত্রাঘাতে বা অপঘাতে মৃত ব্যক্তিদেরও শ্রাদ্ধ হয় এই তিথিতেই (ঘায়েল চতুর্দশী)।

সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, যেহেতু পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম (শ্রাদ্ধ) , তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, সেই হেতু এই পক্ষ শুভকার্যের জন্য প্রশস্ত নয়। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা (ভাদ্রপূর্ণিমা) তিথিতে এই পক্ষ সূচিত হয় এবং সমাপ্ত হয় সর্বপিতৃ অমাবস্যা, মহালয়া অমাবস্যা বা মহালয়া দিবসে। উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়।

পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে; এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সনাতন মহাকব্য (যা শাস্ত্রের মধ্যে ইতিহাস নামে পরিচিত) অনুযায়ী, সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাঁদের উত্তরপুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে সনাতনীদের পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি করতে হয়।

মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাঁকে তাঁর পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়।

সর্বপিতৃ অমাবস্যা দিবসে তিথির নিয়মের বাইরে সকল পূর্বপুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়।যাঁরা নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তাঁরা এই দিন শ্রাদ্ধ করতে পারেন। এই দিন গয়ায় শ্রাদ্ধ করলে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়। উল্লেখ্য, গয়ায় সমগ্র পিতৃপক্ষ জুড়ে মেলা চলে।বাংলায় মহালয়ার দিন দুর্গাপূজার সূচনা হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিন দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হন। মহালয়ার দিন অতি প্রত্যুষে চণ্ডীপাঠ করার রীতি রয়েছে।আশ্বিন শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দৌহিত্র মাতামহের তর্পণ করেন।

মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় দ্বিপ্রহরে নদী বা হ্রদের তীরে বা শ্রাদ্ধকর্তার গৃহে। অনেক পরিবার বারাণসী বা গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.