হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, সকল ধর্মেই মা লক্ষ্মীর উল্লেখ রয়েছে, সীতা যজ্ঞে তাঁর আরাধনা করতেন ভারতের কৃষকরা
ODD বাংলা ডেস্ক: লক্ষ্মীপুজো সনাতন ভারতবর্ষের একটি বহু প্রাচীন উৎসব। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে রয়েছে লক্ষ্মীর উল্লেখ। আবার বৌদ্ধতন্ত্রে দেবী লক্ষ্মীর নাম বসুধারা। জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের মাতা ত্রিশলা রাতে গজলক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন।
প্রাচীন শাস্ত্র এবং পুরাণ ঘেঁটে জানা যায়, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ্মীপুজো সনাতন ভারতবর্ষের একটি বহু প্রাচীন উৎসব। এই উৎসবের সাথে জড়িত আরও বেশ কিছু বিষয়।সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি হল, সমুদ্রমন্থনের সময় লক্ষ্মীর আবির্ভাব।যদিও সমুদ্রমন্থনের কাহিনিতে দেখা যায়, সেখানে অমৃত মন্থনের ফলে সমুদ্র থেকে উত্থিতা হয়েছিলেন এক পদ্মাসনা দেবী, তিনি লক্ষ্মী নন – দেবী শ্রী। তিনিই সুখ, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য সবকিছুর প্রতিভূ। লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণেও কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজো পালনের উল্লেখ আছে। পাল-সেন আমলেও ব্যাপকহারে প্রচলিত ছিল লক্ষ্মীপুজো। সেন আমলে রচিত আর্যাসপ্তশতীতে উল্লেখ রয়েছে লক্ষ্মীপুজোর প্রসঙ্গ।
ঋগ্বেদে লক্ষ্মীর কোনও সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও শ্রী শব্দের উল্লেখ রয়েছে বেশ কয়েক বার। এখানে শ্রী অর্থে সৌন্দর্যের আধার। যদিও পরবর্তী কালে শ্রীসুক্তে উল্লেখ রয়েছে শ্রী নামে এক দেবীর, যিনি পদ্মের উপর আসীন। সেই আদি যুগ থেকেই লক্ষ্মীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে পদ্ম। তাই তিনি পদ্মাসনা, পদ্মালয়া।
বহু শতাব্দী পূর্বে শরৎকালে শস্য কর্তন হলে সীতা যজ্ঞ হত এবং তাতে সীতা এবং ইন্দ্র আহুত হতেন। কৃষক সম্প্রদায়ের কল্পনা প্রসূত এই দেবীকে পুজো করা হত শস্য আর উর্বরতার জন্য। ময়মনসিংহ গীতিকায় লক্ষ্মীপূজার উল্লেখ দেখে বোঝা যায়, সেকালেও এই পুজো কতটা জনপ্রিয় ছিল।
লক্ষ্মী পুজো প্রচলনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে জগৎ শেঠের কাহিনী।বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীকে একবার লক্ষ্মীপুজো নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "এই পূর্ণিমাতে মেয়েরা ঢালের মত বড়, লক্ষ্মীর সরা খরিদ করিয়া আনাইয়া, পূজা করেন। খুব বড় লোক হইতে নিতান্ত গরীব পর্য্যন্ত এই লক্ষ্মীপূজা করেন এবং প্রতি গৃহস্থের ঘরেই যথাসাধ্য এই লক্ষ্মীপূজার আড়ম্বর হইয়া থাকে।" আশ্বিনমাসের শারদপূর্ণিমার কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো তাই দুই বঙ্গেই বড় উৎসব বলেই পরিচিত।
পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু জায়গায় যেমন হুগলি, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের বেশ কিছু জায়গায় বহুকাল গজলক্ষ্মী পুজো হয়। বাংলায় স্মার্ত রঘুনন্দন বর্ণিত চতুর্ভুজা মহালক্ষ্মীর পুজো খুবই কম, দ্বিভুজা প্রতিমা পুজোর চলই বেশি। জনপ্রিয় গবেষক এবং লেখক নীহাররঞ্জন রায় লিখছেন, "দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগর উৎসবের সহিত লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোন সম্পর্কই ছিল না।"
আবার ইন্দুমতি দেবীর বিখ্যাত বই "বঙ্গনারীর ব্রতকথা"য় তিনি লক্ষ্মীপুজোর প্রাচীনত্বের কথা লিখছেন। এই বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাঁর ভূমিকা সম্বলিত এই বইটি পড়লেই বোঝা যায় লক্ষ্মীপুজোর পুজো প্রচলিত ছিল সারা ভারতজুড়ে। ইন্দুমতি দেবী মুর্শিদাবাদের ফতেসিংহ পরগণার প্রচলিত প্রাচীন ব্রতকথাগুলির বর্ণনা দিয়েছেন সুনিপুণ ভাবে। তার মধ্যে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোও আছে।
বৌদ্ধতন্ত্রে আবার দেবী লক্ষ্মী বসুধারা নামে পুজো পেয়ে থাকেন। গবেষকদের কথায়, তিনি দেবী লক্ষ্মীর বৌদ্ধ প্রতিরূপ। বৌদ্ধদের পাশাপাশি জৈন ধর্মেও উল্লেখ রয়েছে দেবী লক্ষ্মীর। মহাবীরের মাতা ত্রিশলা রাতে গজলক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন ।
পূর্ববঙ্গের অনেক বাড়িতে এখনও প্রতি বৃহস্পতিবার নিয়ম মেনে লক্ষ্মীপুজো হয়। আগে পূর্ববঙ্গের অনেক বাড়িতেই লক্ষ্মীর সাথে সাথে কলাবউ পুজোর রীতি ছিল। প্রতি বৃহস্পতিবার কলাবউ পাল্টানো হত। ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহের মত এলাকায় সরাতে লক্ষ্মীপুজোর রীতি দেখা যায়। এই বঙ্গেও বেশ কিছু জায়গায় সরাতে লক্ষ্মীপুজো হয়। আর এই সরা শিল্প বাংলার প্রাচীন লোকশিল্পের ধারাকে বহন করে চলেছে।
Post a Comment