কীভাবে সোনাগাছি হয়ে উঠল এশিয়ার বৃহত্তম যৌনপল্লী

 


সোনাগাছি হল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম যৌনপল্লী এবং ভারতের অন্যতম প্রাচীন যৌনকর্মীদের অঞ্চল। কলকাতার উত্তরাংশে অবস্থিত এই এলাকা দীর্ঘকাল ধরে শহরের একটি উল্লেখযোগ্য এবং বিতর্কিত অংশ হিসেবে পরিচিত। সোনাগাছির ইতিহাসে উঠে এসেছে নারী পাচার, যৌন শোষণ, এবং অসামাজিক কাজের পাশাপাশি মানবাধিকার আন্দোলন ও যৌনকর্মীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য সংগ্রাম।

১. উৎপত্তি ও ইতিহাস:

সোনাগাছির নামটি আসে বাংলা শব্দ "সোনা" থেকে, যার অর্থ সোনা বা স্বর্ণ। বলা হয়, ব্রিটিশ শাসনামলে এই এলাকাটি মূলত ছিল অভিজাতদের বিনোদনের স্থান, যেখানে ধনী ব্যক্তিরা তাদের মনোরঞ্জনের জন্য যেতেন। ধীরে ধীরে এটি একটি যৌনপল্লী হিসেবে গড়ে ওঠে, এবং কলকাতার অপরাধ জগতের সাথে এর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তবে সঠিকভাবে কবে থেকে সোনাগাছি যৌনকর্মীদের এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, তা নিয়ে নানা মতপার্থক্য রয়েছে।

২. নানা সময়ে পরিবর্তন:

ব্রিটিশ শাসনের সময়ে কলকাতায় সোনাগাছির মতো এলাকাগুলোতে যৌনকর্মীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হলেও, স্বাধীনতার পর থেকে এই এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপ বাড়তে থাকে। সময়ের সাথে সাথে এখানে স্থানীয় এবং বাইরের অনেক নারীকে জোরপূর্বক আনা হয় এবং যৌনকর্মে নিযুক্ত করা হয়। মূলত গ্রামীণ এবং দরিদ্র পরিবার থেকে আসা মেয়েরাই এই পাচারের শিকার হত।

৩. যৌনশ্রম এবং শোষণ:

সোনাগাছির যৌনকর্মীরা দীর্ঘকাল ধরে নানা ধরনের শোষণ এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দারিদ্র্য এবং সামাজিক অবজ্ঞার কারণে এই পেশায় জড়িত হতে বাধ্য হয়েছেন। সোনাগাছির যৌনকর্মীরা অনেক সময় মাদকাসক্ত, দালালের প্রভাবাধীন, এবং পাচারের শিকার হয়েছেন। এই এলাকায় সঠিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবাধিকারের অভাব ছিল দীর্ঘদিন ধরে একটি বড় সমস্যা।



৪. মানবাধিকার আন্দোলন:

১৯৯০-এর দশক থেকে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য নানা সংগঠন কাজ শুরু করে। এই আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা হলো "দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি" নামে একটি সংগঠন, যা যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য, অধিকার, এবং নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে। এই সংগঠনের মাধ্যমে যৌনকর্মীরা প্রথমবারের মতো নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলা এবং লড়াই করার সুযোগ পান। সংগঠনটি যৌনকর্মীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা, এইচআইভি প্রতিরোধ, এবং আইনি সহায়তা প্রদান করে।

৫. বর্তমান পরিস্থিতি:

বর্তমানে সোনাগাছি একটি সুপরিচিত এলাকা, যেখানে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ যৌনকর্মী বাস করেন। যদিও এখানে উন্নয়নের নানা কাজ হয়েছে, তবুও সামাজিক কলঙ্ক এবং বৈষম্যের কারণে যৌনকর্মীরা এখনও নানা সমস্যার সম্মুখীন হন।

৬. সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি:

সোনাগাছির ইতিহাস সমাজের চোখে একদিকে যেমন কলঙ্কিত, অন্যদিকে এটি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই নেতিবাচক থাকে, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। তবে, সোনাগাছি এখন কেবল একটি যৌনপল্লী নয়, বরং এটি নারীদের অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য চলমান সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

উপসংহার:

সোনাগাছি হল একদিক থেকে সমাজের নিগৃহীত এবং অবহেলিত নারীদের কষ্টের প্রতিচ্ছবি, আবার অন্যদিকে এটি নারীদের অধিকার এবং সম্মানের জন্য সংগ্রামের উদাহরণ। এই এলাকাটি যৌনকর্মীদের মানবাধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.